রোগ নির্ণয় ডাক্তারিতে একটা ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। নিউরোসার্জারিতে ইউকেতে কাজ শুরু করার পর দেখি ৯০ শতাংশ রোগই ডায়াগনোসিস হয়ে আসে আমাদের কাছে। তাই ভাবনাটা অত না ভাবলেও চলে।
তারপরও আমার সাপ্তাহিক মোটামুটিভাবে নিয়মিত কনসালটেন্ট অনকলের পরের দিন মঙ্গলবার সকালবেলা অল্প সময়ের মধ্যে যখন অনেক সিদ্ধান্ত দিতে হয়, আমার মনে হয় আমার মস্তিষ্কটা সপ্তাহের সে সময়ই সবচেয়ে দ্রুত চলে। এবং তখনও মাঝে মাঝে ডায়াগনস্টিক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়।
কয়েক দিন আগে ১৭ বছরের এক মেয়ে এলো তীব্র মাথাব্যথা নিয়ে। মাথার ভিতরে রক্তপাতের সমস্ত উপসর্গ। কিন্তু রক্তের চিহ্নমাত্র পাওয়া যায়নি সিটি স্ক্যানে। এই বয়সে এ রকম রক্তপাত অল্প কিছু কারণ ছাড়া সাধারণত ঘটে না। বেশ বুঝতে পারছিলাম, রোগ নির্ণয় শেষ হয়নি।
আরেকটা ব্যাপার মাথায় ঘুরছিল। ১৭ বছরের মেয়েদের মাথা ব্যথা অনেক ক্ষেত্রেই ফাঙ্কশনাল মানে—‘তেমন কিছু না ঠিক হয়ে যাবে’ বলে চালিয়ে দেয়া হয়। যে ব্যাপারটা আমার দু’চোখের বিষ।
এর ভিতর আরো কিছু উপসর্গ ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা যোগ-বিয়োগ শেষে এক জুনিয়রকে বললাম, লাম্বার পাংচার (পিঠ ফুটো করে মাথার পানি বের করার একটা প্রক্রিয়া) করতে।
সে ঠিকঠাক মতো করতে পারে না বলে আমাকে বোঝাতে চাইলো, লাম্বার পাংচারের দরকার নেই। রোগী ও চায় না তার মাও চায় না।
ছেলেটা এখানকার গ্রাজুয়েট। এদের সমস্যা হলো, এরা কাজ করে; কিন্তু কাজের থেকে কথা একটু বেশি বলে।
আমি বললাম, রোগী না চাইলেও, চাওয়াও। ভালো করে বুঝিয়ে চাওয়াও। আর পাশে দাঁড়ানো এক ভারতীয় মিডল গ্রেডকে বললাম, তুমি কি একটু ব্যাপারটা ভালোমতো সম্পন্ন করা নিশ্চিত হলে আমাকে একটা টেক্সট পাঠাতে পারো? এই ছেলেটাকে আমি ভালো করে চিনি। কোন কিছু বললেই প্রায় সাথে সাথেই ঝাঁপিয়ে পড়ে। এই ঝাঁপিয়ে পড়া ব্যাপারটা আমার খুবই পছন্দের।
লাম্বার পাংচারের পরে দেখা গেল, ভীষণ রকমের ব্যতিক্রমী এক জীবাণু। সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ আমাকে জানালেন, এটা এসেছে পরিপাকতন্ত্র থেকে। সেটা নিয়ে আরো কিছু ইনভেস্টিগেশন করতে বললাম ওই জুনিয়রকে।
বিরল একটা রোগ ধরা পড়লো। জীবনে প্রথম এই জিনিস আমার সামনে এলো। অপারেশনটাও জীবনে প্রথমবারের মতো করলাম। আরো দুজন কনসালটেন্ট এই ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন। তাদেরকেও দাওয়াত দিলাম। কাউকে পারতপক্ষে না বলি না। যদিও এক্ষেত্রে আমার পারফরমেন্স মূল্যায়ন করার একটা ব্যাপার আসে। অন্যদিকে পারফরমেন্স ভালো করতে পারলে সবার সামনে হাততালিও জোটে।
এ রকম ‘কেঁচো খুঁড়তে সাপ’ ঘটনা আগেও ঘটেছে। তবে এবারেরটা এতই ব্যতিক্রমী যে খুবই অল্প কিছু কেসের সিরিজ সারা পৃথিবী থেকে রিপোর্ট হয়েছে। আমরাও এটা জার্নালে পাঠাবো।
নিজেকে স্মরণ করিয়ে নিলাম যে, রোগ নির্ণয়ে একেবারে শিকড়ে না যাওয়া পর্যন্ত অনুসন্ধিৎসা অব্যাহত রাখার যে শিক্ষা মেডিকেল কলেজে দেয়া হয়েছে সেটার গুরুত্ব। আর সবকিছু ঠিকঠাক হয়ে রোগী ভালো হয়েছে বলে স্রষ্টাকে ধন্যবাদ জানাই।
এএনএম/