‘জানেন স্যার, এই পৃথিবীতে অন্যায় করে কেউ বাঁচতে পারে না। তার বিচার হবেই’—শাহীনের কথা শুনে আমি তার দিকে তাকালাম। নৌকার উপর ফুরফুরে হাওয়ায় মনটাও ফুরফুরে হয়ে যায়। নীল আকাশের নীচে দিগন্ত বিস্তৃত জলরাশির নিস্তরঙ্গ রূপ দেখতে দেখতে আর মৃদুমন্দ হাওয়া গায়ে মাখতে মাখতে আমি আনমনা হয়ে গিয়েছিলাম । শাহীনের কথায় সম্বিত ফিরে পেলাম।
শরতে হাওড় অনেকটা মনোরম রূপ ধারণ করে। ভরা বর্ষায় যে হাওড় অশান্ত, শরতে সে হাওড় ঘুমন্ত শিশুর মতো শান্ত হয়ে যায়। এই রূপ যে কত মনোহর—তা যে দেখেনি, তাকে বুঝানো বড় কঠিন।
শাহীন—তার দিকে আমার মনোযোগ নিবদ্ধ হতে দেখে সে যেন দারুণ উৎসাহ পেল। গল্পের ঝাঁপি খুলে দিল।
সে বলতে শুরু করলো—
‘আমি যখন ছোট ছিলাম, তখন আমার আব্বা মারা যান। তিন বোন এবং এক ভাইকে নিয়ে আমার আম্মা দুঃখের সাগরে পড়ে গিয়েছিলেন। সহায় সম্পদ তেমন ছিল না।
একজন অসহায় গ্রামীণ নারী কীভাবে সংসারের হাল ধরে রেখেছিলেন—সে কথা বলতে পারবো না। কষ্টে সৃষ্টে দিন কাটছিল। ছাত্র হিসাবে আমি খারাপ ছিলাম না। প্রথম বিভাগে এসএসসি পাস করার পর জেলা সদরের সবচেয়ে ভাল কলেজটিতে ভর্তি পরীক্ষায় সুযোগ পেলাম। কলেজে ক্লাস করতাম, নিজের মতো পড়াশোনা করতাম আর টিউশনি করে নিজের পেট চালাতাম। এভাবে দুই বছর কেটে গেল।
এইচএসসি পরীক্ষার দিলাম। রেজাল্ট ভালই হলো। তারপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে, সেখানেও টিকে গেলাম। খুব কষ্ট হলেও সেখানে ভর্তি হলাম। বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার প্রচুর বন্ধু-বান্ধব জুটে গেল।
শাহীন একনাগাড়ে তার গল্প বলে যাচ্ছে। গড়পড়তা যুবকের চেয়ে সে একটু শুকনা পাতলা। ঠোঁট দুটি ঈষৎ কালো। দীর্ঘদিন রোগে ভোগার পর যেমন কিছুটা কৃশকায় হয়, তেমনি । সে কি অপদ্রব্য সেবন করে? জানি না। আমার চোখ (ক্লিনিক্যাল আই) মানুষ দেখলেই ‘ক্লিনিক্যাল ফিচার’ (রোগের লক্ষণ আছে কি না) খুঁজে বেড়ায় কেন? তার চেহারা সুরত এমন হওয়ার কথা ছিল না। সম্ভ্রান্ত পরিবারের ছেলে সে। বিশ বছর আগে তার এক বোনকে দেখেছিলাম। সদ্য কৈশোর উত্তীর্ণ এক তরুণী। দেখতে বেশ সুন্দরী। ছিমছাম গঠনের গৌর-বর্ণা এমন নারী গ্রামাঞ্চলে তেমন একটা দেখতে পাওয়া যায় না। তার সাথে শাহীনের সাথে কেন যেন মিলছে না!
চেহারা তার যেমনই হউক, শাহীন আমাকে বেশ শ্রদ্ধা করে।
সরকারি দায়িত্ব পালনে আমি ছিলাম আন্তরিক। কারও সাথে খারাপ ব্যবহার করতাম না। লোভ আমাকে স্পর্শ করে না, অবৈধ অর্থ আমাকে আকৃষ্ট করতে পারে না—সে কথা আমার সহকর্মীরা জানতো । সেটাই হয়ত শাহীনের কাছে আমার শ্রদ্ধাভাজন হওয়ার কারণ । সরকারি কর্মকর্তাদের একটা রীতি হলো, দূরে কোথাও বেড়াতে গেলে, সেই এলাকা সম্পর্কে সম্যক অবহিত—এমন কাউকে সাথে করে নিয়ে যাওয়া।
বাংলাদেশের স্বাস্থ্য বিভাগের প্রতিটি ইউনিয়ন, ওয়ার্ডে স্বাস্থ্য বিভাগের মাঠ পর্যায়ের কর্মী আছেন। এই কমিউনিটি হেলথ ওয়ার্কারগণ তাদের কর্মক্ষেত্রের প্রতিটি পথ-ঘাট-বাড়ি চেনেন। তাদেরকে পথের সাথী করে নিলে অনেকটাই দুশ্চিন্তা মুক্ত থাকা যায়। শাহীনকে তাই আমি আমার সাথী করে এনেছি।
আমার মনোযোগ দেখে শাহীন তার কথা বলে যাচ্ছে—
‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে (ঢাবি) ভর্তি হওয়ার পর অনেক বন্ধু-বান্ধব জুটে গেল। ক্লাস করি। ক্লাসের আগে পরে জমিয়ে আড্ডা দেই। চা-চপ-সিঙ্গারা খাই। যতক্ষণ বন্ধুদের সাথে থাকি, ততক্ষণ সময়টা ভাল কাটে। তারপর শুরু হয় যন্ত্রণা। ক্ষুধার যন্ত্রণা। সে যন্ত্রণা দুঃসহ। বন্ধুরা চা-চপ-সিঙ্গারা খাওয়ায়, কিন্তু কেউ পেট ভরে ভাত খাওয়ায় না। আমার হাসিতে তারা যোগ দেয়, কিন্তু আমার ক্ষুধার কষ্ট, লুকানো বেদনা তারা বুঝতে পারে না। প্রায় রাতই না-খেয়ে ঘুমাতে যেতাম।
খাবারের টাকা জোগাড় করার জন্য একসময় অপরাধে জড়িয়ে পড়ি। বিশেষ লোকদের সাথে চললে কিছু আয় রোজগার হয়। কয়েকটি দিন ভালমত চলতে পারি। টাকা ফুরিয়ে গেলে আবার তাদের সাথে অপরাধে জড়াই। এভাবেই দিন কাটছিল। পরিস্থিতি সবসময় অনুকূলে থাকে না। হঠাৎ একদিন পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হই। ক্ষমতাসীন দলের কর্মী পরিচয় দেওয়ার পরও পুলিশ আমাদের ছাড়েনি। জেলখানায় যেতে হলো। আসলে, বিপদে পড়লে কেউ কারও সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসে না ।’
‘জীবনে প্রথমবারের মত জেলখানায় গেলাম। নতুন পরিবেশ, নতুন মানুষ। সবই অচেনা। ধীরে ধীরে অনেকের সাথে পরিচয় হলো। ঘনিষ্ঠতা হলো। গল্পগুজব করে দিন কাটে। এদের মধ্যে একজন ছিল পলাশ। পলাশের সাথে আমার ঘনিষ্ঠতা একটু বেশিই হয়েছিল। একদিন শুনি, তাঁর ফাঁসির রায় হয়েছে। রায় শুনে সে একেবারে নির্বাক হয়ে গেল। আমি তাকে সান্ত্বনা দিতে লাগলাম। অনেক অনুরোধের পর সে মুখ খুললো।’
শাহীন বলতে শুরু করলো, ‘আমাদের গ্রামে একবার একটি খুন হয়। যে-দিন খুন হয়, সেই দিন আমি গ্রামে ছিলাম না। কে, কীভাবে খুন করলো—সে সম্পর্কে আমি কিছুই জানতাম না। তারপরও হত্যাকারী হিসাবে বাদীপক্ষ মামলায় আমার নাম ঢুকিয়ে দেয়। হত্যাকারী তিনজনের সাথে আজ আমারও ফাঁসির রায় হয়েছে। বিশ্বাস করুন, ওই হত্যাকাণ্ডে আমি জড়িত ছিলাম না। এ সম্বন্ধে আমি কিছুই জানতাম না।’
এটকু বলার পর তার চোখ জলে ছলছল করে উঠলো। সে কি কাঁদতে চাচ্ছে না, না কাঁদতে পারছে না, বুঝতে পারছি না। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বড় করে দুই তিনটি নিঃশ্বাস নিল তারপর বললো, ‘এই পৃথিবীতে সৃষ্টিকর্তা একজন আছেন। তিনি সাথে সাথে কাউকে ধরেন না। যখন ধরেন, তখন ছাড়েন না।’
পলাশ বলতে লাগল, ‘আমার জীবনের একটি না-বলা ঘটনা আছে। সেটা কোনোদিন কেউকে বলিনি। আজ আপনাকে বলতে চাই। আমার পিতা ছিলেন প্রচুর ভূ-সম্পত্তির মালিক। আর, আমি ছিলাম আমার পিতার একমাত্র সন্তান। উত্তরাধিকার সূত্রে আমিই এ সবের মালিক হব—এটাই স্বাভাবিক। একদিন হঠাৎ আমার মা মারা যান। মায়ের মৃত্যু আমাকে বেশ কষ্ট দেয়। পায়ের তলার মাটি যেন সরে যায়। মনে হয়, বেঁচে থাকার সবচেয়ে আশ্রয়টি আমার ধ্বংস হয়ে গেছে। আমি ও আমার পিতা—এই দুইজন মানুষকে রান্না করে খাওয়ানোর কেউ নেই। অনেক সম্পত্তি থাকার পরও আমাদের জীবন চালানোটা বেশ কষ্টকর হয়ে গেল।
“মা নাই গৃহে যার
সংসার অরণ্য তার”
আমার মত আমার পিতাও নিঃসঙ্গ অনুভব করেন।
নিঃসঙ্গতা ঘোচাতে কিছুদিন পর তিনি বিয়ে করলেন। কিন্তু নিজের জন্মদাত্রী মায়ের অভাব তো আমার কোনোভাবেই পূরণ হয় না। বছর খানেক পর আমার নতুন মায়ের ঘরে এক ছেলে হলো।
পাড়ার লোকেরা আমাকে ঠাট্টা মশকরা করে বলতে লাগল, ‘তুমি তো তোমার বাবার পুরো সম্পত্তি একাই পেতে। আজ থেকে তোমার বাবার সম্পত্তি দুই ভাগ হয়ে গেল। তোমার আদরও কমে গেল।’
‘আজ থেকে তোমার বাবার সম্পত্তি দুই ভাগ হয়ে গেল। তোমার আদরও কমে গেল’—এর চেয়ে বড় ভ্রাতৃঘাতি কথা পৃথিবীতে আর নেই। যারা এ কথা বলে অন্য ভাইয়ের মনে বিদ্বেষ ঢুকিয়ে দেয়, তাদের চেয়ে বড় পাপী পৃথিবীতে আর নেই।’
পলাশ বলে চলেছে, ‘সত্য হউক, মিথ্যা হউক, একই কথা বারবার বলায়, কথাটি আমার মনে শিকড় গাড়ে। এরপর থেকে আমি আমার সৎ-ভাইটিকে দু’চোখে দেখতে পারতাম না। তার প্রতি আমার মনে স্থায়ী একটা বিদ্বেষ তৈরি হয়ে গেল। আমার সৎ-ভাইটি ধীরে ধীরে বড় হতে লাগলো। আড়াই বছর বয়সে পড়লো। টুক টুক করে হাঁটে। আধো আধো বোলে কথা বলে। কাছের দূরের আত্মীয়রা তাকে বেশ আদর করে। একদিন সে কাকী পুকুরের পাড় ধরে হাঁটছিল। আশপাশে কেউ ছিল না। তখনই আমার মাথায় দুষ্ট বুদ্ধিটা আসে। আমি গিয়ে এক ধাক্কা মেরে তাকে পুকুরে ফেলে দিলাম। ফুটফুটে সুন্দর শিশুটি পানিতে ডুবে যায়। তারপর, অনেক খোঁজাখুঁজি করেও তাকে পাওয়া যায়নি। বেশ কিছুক্ষণ পর তার মরা লাশ ভেসে উঠল। আমার সৎ-মা মাটিতে গড়াগড়ি করে কাঁদছিল। তার বুকফাটা চিৎকারে সবার চোখ ছলছল করছিল। আমার চোখও। সবাই জানল, অবোধ শিশুটি পানিতে পড়ে মারা গেছে। কে তাকে হত্যা করেছে—সে কথা কেউ জানলো না।’
পলাশের সরলোক্তি, ‘শাহীন ভাই, যে হত্যাকাণ্ডের জন্য আমার ফাঁসির রায় হয়েছে, সত্যি বলছি, সে হত্যার সাথে আমি জড়িত ছিলাম না। তবে আমি যে আমার আপন ভাইকে মেরে ফেলেছি—এটা সত্য এবং পৃথিবীর কেউ সে-কথা জানে না। হয়ত আমার ফাঁসি হবে। সেজন্য আমার দুঃখ নেই। কেউ যদি মারাত্মক পাপ করে, তাহলে আল্লাহ তাকে শস্তি দিবেনই। কী লাভ হল আমার? সৎ ভাইটা বেঁচে থাকলে সম্পত্তির অর্ধেক সে পেত। বাকী অর্ধেক আমি পেতাম! এখন তো কিছুই পেলাম না।’
এক নাগাড়ে নিজের এবং পলাশের জীবনের কাহিনী বলে শাহীন থামলো। এ যেন কাহিনী নয়, ব্যথার রাগিণী। শান্ত নদীর বুকে ফুরফুরে বাতাসে আমার যে আনন্দ অনুভূত হচ্ছিল, শাহীন এবং তাঁর জেলখানার বন্ধু পলাশের গল্প শুনে পুরো আনন্দটাই মাটি হয়ে গেল।
এএনএম/