বাংলাদেশের বোর্ডিং নেবার মুহূর্তে টার্কিস কর্তৃপক্ষ জানালো তাদের ফ্লাইট ৬ ঘণ্টা বিলম্ব হবে। সুতরাং আমি যাবো কি যাবো না? আমি তো তথৈবচ। ফ্লাইট শিডিউল একেবারে সময় ধরে মেলানো ছিল। সানফ্রান্সিসকো পৌঁছে রাত্রি যাপন করেই সকাল আটটায় মসকন সেন্টারে যাওয়া আর সাড়ে নয়টায় আমার প্রেজেনটেশন শিডিউল।
বোর্ডিং অফিসার দুঃখ প্রকাশ করে আবার জানতে চাইলেন, কী করবেন? জানালেন, নিজেদের ফ্লাইট বিলম্বে হওয়ার কারণে কারো কোনো আর্থিক ক্ষতি হলে টার্কিশ কর্তৃপক্ষ সেটা বিবেচনা করবেন।
আমি বললাম, আমার যে ক্ষতি হবে, সেটা টাকা দিয়ে পোষাবার নয়। তিনি উৎসুক হয়ে জানতে চাইলে বললাম, একটি সেমিনারে প্রেজেনটেশন আছে। সেটি আর হবে না মনে হয়। তিনিও বেশ দুঃখ প্রকাশ করলেন। তার ভদ্রতা, বাচন ভঙ্গি, সহমর্মিতায়, বারবার দুঃখ প্রকাশ করায় মনোকষ্টে খানিকটা ছেদ পড়লো।
প্লেনে বসে টেকঅফের আগেই আমেরিকান সাইকিয়াট্রিক অ্যাসোসিয়েশনের (এপিএ) সায়েন্টফিক পোগ্রাম ম্যানেজারকে আমার দেরি হবার বিষয়টি দু'লাইন মেইল করলাম।
পরদিন ইস্তাম্বুলের আইবিআইএস হোটেলের লবিতে বসে এক ভারতীয় পরিবারের সঙ্গে টুকটাক গল্প চলছিল। তখনই মোবাইলে ফিরতি মেইল আসলো আমেরিকান সাইকিয়াট্রিক এসোসিয়েশনের সায়েন্টফিক পোগ্রাম ম্যানেজমেন্ট থেকে।
তারা জানালো, দেরিতে কোনো সমস্যা হবে না। প্রেজেনটেশন টাইম শিডিউল তারা এডজাস্ট করে একদিন পিছিয়ে সেটা পোগ্রাম ড্যাসবোর্ডে আপলোড দিয়ে সবাইকে জানিয়ে দেবে যদি আমার কোনো সমস্যা না থাকে।
এতো বড় একটি সায়েন্টিফিক পোগ্রামে নিজের প্রেজেনটেশনটা করতে পারবো—সেটা ভেবে, মনটা ফুরফুরে হয়ে গেলো।
সারাবিশ্ব থেকে প্রায় ১৪ হাজার নিউরো-সাইকিয়াট্রিস্ট, সাইকিয়াট্রিস্টসহ প্রায় সকল ডিসিপ্লিনের দেড় হাজার প্রেজেনটেশন হবে আমেরিকান সাইকিয়াট্রি এসোসিয়েশনের বার্ষিক সায়েন্টিফিক পোগ্রামে। আলাদা এক অনুভূতি।
ভারতীয় যে পরিবারের সঙ্গে লবিতে বসে আলাপ করছিলাম, তারা স্বামী-স্ত্রী, বেশ বয়স্ক। ষাট সত্তোর বয়স হবে। হিন্দি তেমন একটা পারি না বলে ইংরেজিতে গল্প করছিলাম। ভদ্রলোকের কথা আজো মনে আছে।
তারা ভারতের ক্রিকেট কিংবদন্তি কপিল দেবের বেশ ঘনিষ্ঠজন বলে জানালেন। এটা শুনে আমিও আরো জম্পেশ গল্পজুড়ে দিলাম। ক্রিকেট ভালো খেলতে না পারলেও পছন্দ করি ক্রিকেট। অস্ট্রেলিয়া, সাউথ আফ্রিকা, পাকিস্তান ও ভারত—তাদের খেলা ভালো লাগে।
আমাকে হঠাৎ জিজ্ঞেস করলেন, ‘কপিল দেবের নাম শুনেছি কিনা বা চিনি কিনা?
খানিকটা হেসে বললাম, ‘কপিল দেবকে চিনবো না এ হয়? আমার ছেলেবেলা কেটেছে কপিল দেবের খেলা দেখে। তিনি বিশ্ববিখ্যাত অলরাউন্ডার।’
তিনি আমাকে অবাক করে দিয়ে বললেন, আমি ও কপিল দেব এক সাথে অনেকদিন প্র্যাক্টিস করেছি। আমি এক সময় ক্রিকেট খেলতাম। আমেরিকা পাড়ি জমালে আমার আর ক্রিকেট ক্যারিয়ার এগোয়নি।
আমি তার হাত চেপে ধরে ঝাঁকুনি দিয়ে বললাম, ‘এবার কপিল দেবের সাথে কিন্তু হ্যান্ডশেকটা করছি।’
তিনি ও তার স্ত্রী হু হু করে হেসে উঠলেন। পরিবারটি প্রায় ৩০ বছর হলো, সানফ্রান্সিসকোতে স্থায়ী হয়েছে। ভদ্রলোকের শারীরিক গড়ন দেখে বোঝাই যায় তিনি যে ক্রিকেটার ছিলেন।
আমেরিকান সাইকিয়াট্রিক এসোসিয়েশনের সায়েন্টফিক পোগ্রামে প্রেজেনটেশন করতে যাচ্ছি শুনে বেশ প্রশংসা করলেন। তার উৎসাহব্যঞ্জক কথাগুলো আজো মনে আছে।
তাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে একটি উবার নিয়ে বেড়িয়ে পড়লাম বসফরাস প্রণালী পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া হাইওয়ে ধরে ইস্তাম্বুলের ঐতিহাসিক গ্রান্ড সুলতান মসজিদ ও নীল মসজিদ দেখতে।