দেশের উত্তর-পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে চলমান বন্যায় এত এত দুঃখ ও দুর্দশা। তবুও এই হাহাকারের মধ্যেও যে বিষয় আমাদের মন ভালো করে দেবে, শক্তি যোগাবে, প্রেরণা দেবে তা হচ্ছে জাতীয় ঐক্য।
ইতোমধ্যেই বেশ কিছু অঞ্চলে সূর্যের দেখা পাওয়া গেছে। তিস্তা অঞ্চলে বন্যার আশঙ্কাও নেই। এত সব আশার কথার মধ্যেও বন্যাকে ঘিরে অভূতপূর্ব এক জাতীয় ঐক্য তৈরি হয়েছে দেশের মানুষের মধ্যে। এসব আমাদের আশান্বিত করে। যেমন-
১. বৃষ্টি কমে সূর্যের দেখা। বন্যার পানি কমতে শুরু করেছে বিভিন্ন অঞ্চলে। তিস্তার পানি বিপৎসীমার নিচে। এই অঞ্চলে বন্যার শঙ্কা নেই। তিস্তা পাড়ের মানুষদের আতঙ্কিত না হওয়ার পরামর্শ দিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ড।
২. ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, শেরে বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, কক্সবাজার মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, রাঙামাটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও ইবনে সিনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ইন্টার্ন চিকিৎসকবৃন্দ তাদের এক দিনের বেতনের সমপরিমাণ টাকা বন্যার্তদের জন্য দান করার ঘোষণা দিয়েছেন। আরও মেডিকেল এই উদ্যোগে যুক্ত হচ্ছে।
৩. ঢাকা ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ইন্টার্ন চিকিৎসকবৃন্দ তাদের সেন্ট্রাল ট্যুরের জন্য জমানো পুরো টাকাটাই বন্যার্তদের জন্য ডোনেট করছে।
৪. আস-সুন্নাহ ফাউন্ডেশনের ত্রাণসামগ্রী প্রস্তুতের জন্য স্বেচ্ছাসেবক আহবান করা হয়েছিল। ৫০০ টন ত্রাণসামগ্রী প্রস্তুত করা চাট্টিখানি কথা নয়। এ এক অভাবনীয় সুন্দর দৃশ্যের সৃষ্টি হয়েছে! হাজার হাজার মানুষ সাহায্য করার জন্য সেখানে গিয়ে উপস্থিত হয়েছেন। এমন অবস্থা এতো মানুষের দাঁড়ানোর ব্যবস্থাও করা যাচ্ছিল না মাঠে। পরবর্তীতে তাদের অফিশিয়াল পেইজে জানাতে বাধ্য হয়েছে, "নতুন করে আর কাউকে না আসার অনুরোধ করছি।"
৫. আস-সুন্নাহ ফাউন্ডেশনের এই কার্যক্রেমে এক পা হারানো এক ভাই দুই ক্রাচে ভর করে সাহায্য করতে চলে এসেছেন। আবারও প্রমাণিত হলো, দুর্দম ইচ্ছেশক্তির মাধ্যমে একজন মানুষ তার সামর্থ্য-সক্ষমতাকে ছাড়িয়ে যেতে পারে।
৬. ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন যে খাদ্য ও পোশাক ত্রাণ হিসেবে সংগ্রহ করেছে তার পরিমাণ বিস্ময়কর। এছাড়াও গতকাল রাত পর্যন্ত তাদের সংগ্রহ ত্রিশ লাখ টাকার বেশি।
৭. চিকিৎসকদের অর্গানাইজেশন ড্রিমার্স ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট সেন্টার পানি, চিড়া, মিঠাই, লাইফ জ্যাকেট, রেইনকোট, মোমবাতি, লাইটার, বড় ইঞ্জিন চালিত নৌকা, ওষুধ, গ্লুকোমিটার, স্ট্রিপ, ইউরিন স্ট্রিপ বক্স, ইসিজি মেশিন, অন্যান্য মেডিকেল ইন্সট্রুমেন্টসহ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের টিম ফেনী গিয়েছেন। চিকিৎসকরা মূলত ইমার্জেন্সি রেসকিউ অ্যান্ড রিসাসিটেশানের জন্য যাচ্ছেন। আরও অনেক চিকিৎসক যেতে চেয়েছিলেন কিন্তু এই মুহূর্তে সবাইকে নিয়ে যাওয়া সম্ভব না। তাদের পক্ষ থেকে পরবর্তীতে বেশ কয়েকটি হেলথ ক্যাম্প হবে বন্যাদুর্গত অঞ্চলে।
৮. বৈষম্যবিরোধী চিকিৎসক ও স্টুডেন্ট পরিষদের ব্যানারে প্রায় ২৫ জনের একটি টিম জরুরি চিকিৎসা ও ত্রাণ সামগ্রী প্রদানের জন্য কুমিল্লার বুড়িচং-এ গিয়েছেন।
৯. আমার ৯ বছরের রিডিং পার্টনার বন্ধু বিসিএস কর্মকর্তা ডা. ইন্দ্রজিৎ সরকার ও ময়মনসিংহে আমার প্রাক্তন রুমমেট কার্ডিওলজিস্ট বন্ধু ডা. অনির্বাণ মোদক পূজন ভিন্ন ধর্মাবলম্বী হয়েও বিশ্বস্ত আস-সুন্নাহ ফাউন্ডেশনে বন্যার্তদের সহযোগিতার জন্য ডোনেট করেছেন।
১০. বরিশালের চক্রবর্তী বাড়ি দুর্গা ও লোকনাথ মন্দিরের পক্ষ থেকে বন্যার্তদের সহযোগিতার জন্য তারা ডোনেশান পাঠিয়েছেন ইসলামিক স্কলার আহমাদুল্লাহর আস-সুন্নাহ ফাউন্ডেশনে। আসন্ন দুর্গোৎসবের বাজেট থেকে তারা এই অর্থ দান করেছেন। এমন আরও বেশ কয়েকটি খবর পাওয়া গেছে, যারা পূজোর অর্থ থেকে আস-সুন্নাহতে ডোনেট করছেন।
১১. প্রীতি দত্ত তাদের পরিবারের পুরো বাজেট আস-সুন্নাহতে ডোনেট করেছেন। প্রবাসী ইতিকা ইতু অত্যন্ত জাঁকজমকপূর্ণভাবে প্রতি বছর তাদের বাড়িতে দুর্গোৎসবের আয়োজন করেন। কিন্তু এই বছর পূজোর ফান্ডের একটি বড়ো অংশ বন্যার্তদের জন্য দিয়ে দিয়েছেন।
১২. একটা ছোট্টো ছেলে উমরাহ করার জন্য টাকা জমাচ্ছিল। তার জমানো সব টাকা সে বন্যার্তদের জন্য দান করে দিয়েছে। বলেছে, আল্লাহ তাওফিক দিলে আবার পরে উমরাহ করতে যেতে পারবে।
১৩. বৌদ্ধ ভিক্ষুরা কোমর সমান পানি পেরিয়ে বাড়ি বাড়ি গিয়ে ত্রাণ দিয়ে আসছেন। তারা দেখছেন না কে কোন ধর্মের।
১৪. আজ জুম’আর নামাজের পর বিভিন্ন মসজিদের মুসল্লিদের কাছ থেকে বন্যার্তদের জন্য দান আহবান করার বিষয়ে আলোচনা হচ্ছে।
১৫. বিসিএস স্বাস্থ্য ক্যাডার এই আপদে তাদের সকল ছুটি বাতিলের প্রজ্ঞাপন জারি করে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বানভাসি অঞ্চলে স্বাস্থ্যসেবা দিয়ে যাচ্ছে।
১৬. বিকাশ, ঢাকা পোস্ট, Fabrilife সহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা একদিনের বেতনের সমপরিমাণ টাকা বন্যার্তদের জন্য ডোনেট করেছেন।
১৭. উপদেষ্টা হিসেবে পাওয়া প্রথম মাসের বেতন প্রধান উপদেষ্টার ত্রাণ তহবিলে ডোনেট করার ঘোষণা দিয়েছেন আসিফ মাহমুদ।
১৮. চট্রগ্রাম থেকে শত শত বোট নিয়ে ফেনী-নোয়াখালীর উদ্দেশে যাত্রা করেছে মানুষ।
১৯. ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হল-বিভাগ থেকে ডজন ডজন টিম বেরিয়ে পড়েছে বন্যাদুর্গত অঞ্চলের উদ্দেশে।
২০. ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর প্রতিষ্ঠিত গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র থেকে বন্যায় দুর্গতদের জন্য জরুরি মেডিকেল ক্যাম্পের ব্যবস্থা করা হয়েছে। ডা. সাকলায়েন রাসেলের আরিজ ফাউন্ডেশন, এনবিএ, উইন এবং আমরাই বন্ধু গ্রুপের যৌথ প্রয়াসে জরুরি ত্রাণ ও চিকিৎসা কার্যক্রম নিয়ে একটি টিম ফেনীতে পৌঁছেছে। গ্রীন লাইফ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসকদের একটি টিম বন্যাদুর্গতদের সেবা করতে গিয়েছেন।
২১. বন্যা দুর্গতদের জন্য এস. এ. গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজ ৮০০ পিস ৫ লিটার পানি এবং ৭৫০ পিস ১ কেজি লবণ আস-সুন্নাহ ফাউন্ডেশনকে উপহার দিয়েছে।
২২. অনেকে জানিয়েছেন, ত্রাণকর্মীদের জন্য একুশে এক্সপ্রেস তাদের বাস সার্ভিস ফ্রি করে দিয়েছে।
২৩. প্রবাসীর হেলিকপ্টার নামে একটি প্রতিষ্ঠান ফ্রি হেলিকপ্টার সার্ভিস প্রদান করেছে।
২৪. সহকারী পুলিশ সুপার ডা. শোভন হোরের উদ্যোগে বাগবাড়ী পূজা উদযাপন কমিটি, ধনবাড়ি, টাঙ্গাইল-এর পক্ষ থেকে বানভাসিদের জন্য আস-সুন্নাহ ফাউন্ডেশন ডোনেট করা হয়েছে।
২৫. যাত্রাবাড়িতে এক মানসিক প্রতিবন্ধী ভিক্ষুককে দেখা গেলো তার ভিক্ষার বোল থেকে ১০ টাকা নিয়ে ত্রাণ সংগ্রহের বক্সে দান করে দিলেন।
২৬. তিন বছর ধরে টাকা জমায় ৭ বছরের ইহান। টিএসসিতে এসে তার জমানো সব টাকা দিয়ে গেছে বন্যার্তদের সহায়তার জন্য।
২৭. ডক্টরস’ হোপ প্রাইভেট লিমিটেডের কর্মকর্তা-কর্মচারীবৃন্দ তাদের বেতনের একদিনের সমপরিমাণ টাকা বন্যার্তদের জন্য ডোনেট করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
২৮. বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদস্যদের এক দিনের বেতন বন্যার্তদের সহযোগিতায় প্রধান উপদেষ্টার তহবিলে দান।
পরিশেষে বলব-
যত বিপদ
তত ঐক্য
তোমার মাঝেই স্বপ্নের শুরু তোমার মাঝেই শেষ
ভালোলাগার ভালোবাসার তুমি আমার বাংলাদেশ
এনএআর/