কাকতালীয়ভাবে সমাজ সভ্যতার ইতিহাসে সংযুক্ত হাসপাতাল ও চিকিৎসাবিদ্যাপিঠ (রেসিডেন্সিয়াল টিচিং হাসপাতাল), মানসিক হাসপাতাল ও সামরিক হাসপাতাল এই তিনটি গুরুত্বপূর্ণ ধারণাই ইসলামী স্বর্ণযুগ পৃথিবীতে পরিচয় করিয়ে দেয়।
প্রাচীন, মধ্য ও আধুনিক যুগের চিকিৎসা ব্যবস্থা
প্রাচীন যুগে গ্রীকদের ছিলো টেম্পল হিলিং ব্যবস্থা, যা কোন বৈজ্ঞানিক ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে ছিলো না। অলৌকিকতা আর বিভিন্ন বিশ্বাসের উপর নির্ভর করে এই চিকিৎসা সেবা দেওয়া হতো। মিশরীয় ও রোমান সভ্যতায়ও চিকিৎসা সেক্টর ছিলো সে সময়ে খুব গতানুগতিক। চিকিৎসা সেবার উৎকর্ষ যাত্রা মাঝখানের দীর্ঘ একটা সময়ে নিশ্চল হয়ে পড়ে থাকে। তারপর দৃশ্যপটে আসেন মুসলিম মহান শাসকেরা। রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, ‘এক মুসলিমের উপর অপর মুসলিমের অধিকার ছয়টি। তার একটি হলো, অসুস্থাবস্থায় সে তার শুশ্রূষা করবে।’
৭০০-১৪০০ খ্রিষ্টাব্দ। নতুন নতুন ধারণা নিয়ে আসা, বিশাল বিশাল বাজেটের হাসপাতাল প্রকল্প বাস্তবায়ন এবং ফার্মাকোথেরাপিউটিক্স ও সার্জিক্যাল এপারেটাস ডেভেলপমেন্ট চরম অগ্রগতির শেখরে পৌঁছে। আজকে আমরা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) ঘোষিত যে সার্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা (ইউনিভার্সাল হেলথ কাভারেজ) কিংবা সবার জন্য স্বাস্থ্যের কথা বলছি, মধ্যযুগ মূলত আমাদের সাথে তা প্রথম পরিচয় করিয়ে দেয়।
আজকের একটি আধুনিক হাসপাতালের ধারণায় আমরা কী কী প্রত্যক্ষ করি? একটি আউটপেশেন্ট ডিপার্টমেন্ট (ওপিডি), ইনপেশেন্ট প্যালিয়েটিভ কেয়ার (আইপিপিসি), ম্যাটার্নাল সার্ভিস, অ্যাকিউট ম্যানেজমেন্ট, ইমিউনাইজেশন সার্ভিস, রিহ্যাবিলিটেশন কেয়ার এবং জেনারেল অপারেটিভ মেডিসিন। তাই নয় কি?
বিমারিস্তান ও চিকিৎসায় স্বর্ণযুগের শুরু
৮৭৪ খ্রিষ্টাব্দের দিকে উল্লিখিত সকল ডিসিপ্লিনে সম্মিলিতভাবে চিকিৎসা সেবার মডেল নিয়ে একটি হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা হয় বর্তমান মিশরের কায়রো শহরে। নাম– আহমাদ ইবনে তুলুন। অবশ্য তারও আগে, নবম শতকের শেষ দিকে আব্বাসীয় শাসক খলিফা আল মনসুর ইরাকের বাগদাদ শহরে একটি হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করেন বিমারিস্তান আল রাজি নামে। ফারসি ‘বিমার’ শব্দের অর্থ হলো অসুস্থতা, অর্থাৎ যেখানে রোগগ্রস্ত সেবাগ্রহীতারা একসাথে হোন। এ ছাড়া দশম শতাব্দীর শেষ দিকে ২৪ জন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক নিয়ে তৈরি বাগদাদী হাসপাতালের কথা জানা যায়।
বর্তমান তিউনিশিয়ায় প্রতিষ্ঠিত আল কায়রাওয়ান হাসপাতাল ছিল সে সময়ের একটি অত্যাধুনিক চিকিৎসা সেবা কেন্দ্র, যা নবম শতাব্দীতে তৈরি হয়। যেখানে লেপ্রোসী (হ্যানসেনের রোগ নামেও পরিচিত) আক্রান্ত রোগীদের জন্য সম্পূর্ণ আলাদা একটি ওয়ার্ড ছিলো ‘আল জুধামা’ নামে।
খ্রিষ্টীয় ১২ শতকের দিকে একটি হাসপাতাল খুব নাম করে, বর্তমান সিরিয়ার দামেস্ক শহরে অবস্থান, ‘আল নূরী হাসপাতাল’। যা বিশেষত অর্থোপেডিক্স সার্জারি, জেনারেল সার্জারি এবং অপথালমোলজির জন্য বিখ্যাত হয়ে ওঠে। আল নূরী হাসপাতাল পরিচালনায় প্রতিদিন প্রায় চার লক্ষ টাকা ব্যয় হতো। এটি একটি মেডিকেল কলেজ। এখানে ছিলো মেডিকেল লাইব্রেরি, ছিলো লেকচার গ্যালারিও। ইতিহাসখ্যাত বীর ও বায়তুল মুকাদ্দাসজয়ী শাসক নূরুদ্দীন জেঙ্গি এটি প্রতিষ্ঠা করেন।
আল নূরী মেডিকেল থেকে শিক্ষা সম্পন্ন করাদের একজন হলেন বিখ্যাত চিকিৎসক ইবনে আল নাফিস, যিনি মানবদেহের লেজার সার্কুলেশন অর্থাৎ ফুসফুসীয় রক্তসংবহন আবিষ্কার করেন। এ বিষয়ে তার ‘কমেন্টারি অন অ্যানাটমি অব আভিসেনা’স ক্যানোন অব মেডিসিন’ গ্রন্থে বর্ণনা পাওয়া যায়।
হাসপাতাল ব্যবস্থা বিবর্তনে মধ্যযুগীয় স্বর্ণযুগ পাঠ করতে গেলেই মিশরের কায়রোর কথা বারবার চলে আসে। কারণ কায়রোতেই বড় বড় তিনটি আধুনিক হাসপাতালের কথা আমরা জানতে পারি। এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত ছিল আল মানসুরী হাসপাতাল। সেটি ১৩ শতকের কথা। মামলুক শাসক আল মনসুর কাওয়ালুন দামেস্কে এক অভিযানে গেলে ‘আল নূরী হাসপাতালে’ তার রেনাল স্টোন (কিডনি পাথর) অপসারণ করতে হয়। তিনি আল নূরী হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা দেখে এতোটাই মুগ্ধ হোন যে, কায়রোতে ফিরে এসে বড়সড় একটা বিশেষায়িত হাসপাতাল তৈরির প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। তিনি তার কথা রাখেন। ১২৮৪ সালে কায়রোতে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘আল মানসুরী হাসপাতাল’।
পর্যাপ্ত সংখ্যক চিকিৎসক, নার্স, ডিস্পেন্সারি, নারী-পুরুষের আলাদা ওয়ার্ড, স্পেশালিটিভিত্তিক ডিপার্টমেন্ট, রোগীদের থাকার খাটের জন্য উন্নতমানের তোষক সরবরাহ, হাসপাতালের প্রত্যেক অংশে সুপেয় পানির ব্যবস্থা, রেসিডেন্সিয়াল মেডিকেল অফিসারদের আবাসন, শিক্ষার্থীদের জন্য পাঠদান ব্যবস্থা– এসব কিছু নিয়ে আল মানসুরী হাসপাতাল তার সেবা কার্যক্রম অব্যাহত রাখে।
মূলত চিকিৎসা সেবার এই প্রতিষ্ঠানগুলোর সাফল্যের জন্যই আবাসিক হাসপাতালের ধারণা পুরো মুসলিম বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। এর ফলে হাসপাতাল স্থাপিত হয় স্পেনের আন্দালুস, সিসিলি এবং উত্তর আফ্রিকায়। একই ধারাবাহিকতায় ইউরোপেও ছড়িয়ে পড়ে এর বৈপ্লবিক প্রসার। এখানে বলা যায় ফ্রান্সের হস্পিটিলিয়ার্সের কথা, যা ছিলো খুব প্রসিদ্ধ। আবার দক্ষিণ ইউরোপে হাসপাতাল স্থাপনে এগিয়ে আসেন মুসলিম চিকিৎসকরাই। দক্ষিণ ইতালির ‘সালেরনো হাসপাতাল’ এমনই এক উদাহরণ।
চিকিৎসার উত্তরাধিকার ও প্রত্যাশা
সময়ের বিবর্তনে আজ আমাদের চিকিৎসাবিজ্ঞান আরো একশো ধাপ এগিয়ে একবিংশ শতাব্দীর মাইক্রো থেকে ন্যানো অ্যাপ্রোচের যুগে আমরা প্রবেশ করেছি। একদিকে যেমন বিশাল বিশাল গবেষণা ল্যাবে চলমান, তেমনিভাবে ইন্টারভেনশন কিংবা কিউর মেডিসিনের জন্য স্থাপন হয়েছে অত্যাধুনিক আল্ট্রা স্পেশালাইজড সব হাসপাতাল। আর মানবসভ্যতার এই লিগ্যাসি অব হিলিং (চিকিৎসার উত্তরাধিকার) পড়তে গেলেই চলে আসে মুসলিম লিগ্যাসি, যা সোনালী মধ্যযুগ দিয়ে ইউরোপীয় রেনেসাঁ পার হয়ে আজ একুশ শতকের এই উৎকর্ষতায়।
আমাদের কামনা, মুসলিম বিশ্ব এবং মুসলিম তারুণ্য তাদের সোনালী ইতিহাস পাঠ করবেন, বিশ্বকে তারা চিকিৎসা বিজ্ঞানে কি দিয়েছেন জানবেন, এবং আগামীতে বিশ্বকে আবারো দেওয়ার প্রস্তুতি নেবেন, চিকিৎসাবিজ্ঞানে বিশ্বকে বলিষ্ঠ নেতৃত্ব দেবেন। বাংলাদেশ একটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ হিসেবে এই অপার সম্ভাবনার ভূ-খণ্ডে পৃথিবীখ্যাত সকল ল্যাব এবং হাসপাতাল একদিন গড়ে উঠবে, এতটুকু চাওয়া কি খুব অবাস্তব আর অন্যায় হবে? নিশ্চয়ই না।
ব্যবহৃত রেফারেন্স:
১০০১ ইনভেনশনস: দ্য এন্ডিউরিং লিগ্যাসি অব মুসলিম সিভিলাইজেশন, আরামকোওয়ার্ল্ড, উইকিপিডিয়া ও রিসার্চগেট।
এনএআর/