মেডিভয়েস রিপোর্ট: নতুন করে বহু পণ্যে ভ্যাট বাড়িয়েছে সরকার। এতে প্রভাব পড়েছে নিত্যপণ্য থেকে শুরু করে ওষুধের দামেও। এমন পরিস্থিতিতে অত্যাবশ্যকীয় ওষুধ সহজলভ্য করার লক্ষ্যে তালিকা হালনাগাদের উদ্যোগ নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার।
সোমবার (১৩ জানুয়ারি) স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে আয়োজিত এক সভায় সরকারের পক্ষ থেকে এ কথা বলা হয়। এতে বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানির মালিক, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, বিশ্বব্যাংক, যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক উন্নয়নবিষয়ক সংস্থার (ইউএসএআইডি) প্রতিনিধিসহ বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, পেশাজীবী সংগঠন এবং অধিকারকর্মীরা অংশ নেন। মন্ত্রণালয় কর্তৃক আয়োজিত সভায় উপস্থিত ওষুধ কোম্পানির মালিকেরা বলেন, ওষুধের সঠিক মূল্য না পেলে ওষুধ কোম্পানিগুলো টিকতে পারবে না।
অনুষ্ঠানের শুরুতে প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী অধ্যাপক ডা. সায়েদুর রহমান বলেন, দেশের ওষুধশিল্পের উল্লেখযোগ্য বিকাশ ঘটলেও দেশের মানুষের স্বাস্থ্য ব্যয়ের বড় অংশ চলে যায় ওষুধের পেছনে। স্বাস্থ্যের রক্ষা, উন্নতি ও অর্জন—এসবের জন্য ওষুধের ব্যবহারকে আরও অর্থবহ করার সুযোগ আছে। বিভিন্ন পক্ষ কীভাবে সেই অবদান রাখতে পারে সে ব্যাপারে খোলামেলা আলোচনার জন্য উপস্থিত সবার প্রতি আহ্বান জানান তিনি।
রোগ প্রতিরোধের ক্ষেত্রে ভ্যাকসিন এবং রোগ নিরাময়ে ওষুধ ভূমিকা রাখে বলে জানান প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী।
তিনি বলেন, ‘এক সময় আমরা ৮০ ভাগ ওষুধ আমদানি করতাম, এখন দেড় শতাধিক দেশে রপ্তানি করি। কিন্তু আমাদের দেশে রোগীদের চিকিৎসা পেতে গিয়ে যত খরচ করে তার বেশিরভাগই যায় ওষুধ খাতে। এজন্য আমরা একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক স্বাস্থ্য কাঠামো তৈরি করতে চাই। সব মানুষ যাতে সাশ্রয়ী দামে মানসম্মত ওষুধ পায়, সেজন্যই আমাদের এই প্রয়াস।’
তিনি আরও বলেন, দীর্ঘদিন আগে অত্যাবশ্যকীয় একটি ওষুধের তালিকা করা হয়েছিল, যাতে ৯০ ভাগ মানুষের অসুখ হলে এগুলো ভূমিকা রাখতে পারে। পরবর্তীতে সেটি নানাভাবে সংযোজন হয়েছে। এটাকে হালনাগাদ ও ওষুধের প্রাপ্যতা নিশ্চিত করা আমাদের মূল লক্ষ্য। কোন ওষুধগুলোর ক্ষেত্রে কোন মডেল আমরা বেছে নিতে পারি সেটি দেখতে হবে।
ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যালসের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবদুল মুক্তাদির বলেন, ‘বাংলাদেশের ওষুধ কোম্পানিগুলো অতিশয় কম দামে ওষুধ বিক্রি করে। এখানে যত কম দামে ওষুধ পাওয়া যায়, তার পৃথিবীর আর কোথাও নেই। বিদ্যুৎ, কর্মীদের বেতনসহ প্রতিটিতে খরচ বেড়েছে। তবে আমরাও চাই মানুষ সাশ্রয়ী মূল্যে ওষুধ পাক। এজন্য নীতিনির্ধারকদের মূল নির্ধারণে পূর্ণাঙ্গ জানা থাকতে হবে।
তিনি বলেন, বাংলাদেশের ওষুধের বাজার ৩০ হাজার কোটি টাকার। এতে একজন নাগরিকের বছরে মাথাপিছু ওষুধ বাবদ খরচ হয় ১ হাজার ৭৬৪ টাকা। মাথাপিছু এত কম দামে ওষুধ বিশ্বের আর কোথাও নেই। ওষুধ নীতিতে ধোঁয়াশা আছে বলে উল্লেখ করেন আবদুল মুক্তাদির। বলেন, ‘আমাদের বাদ দিয়ে কিছু করবেন না। আমরা এমন কিছু করবো না, যাতে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হয়।’
কোনো ওষুধের দাম বাড়াতে চান না জানিয়ে তিনি ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যালসের চেয়ারম্যান বলেন, সমাধান করতে চাইলে কারো কথায় নয়, ভেবে চিন্তে ডব্লিউএইচও’র অত্যাবশ্যকীয় তালিকা অনুযায়ী অত্যাবশ্যকীয় ওষুধের তালিকা হালনাগাদ করা যেতে পারে। সরকারের সঙ্গে আমাদের কোনো বিবাদ নেই। আমরাও দেশের মঙ্গল চাই। এ ব্যাপারে ফার্মাসিউটিক্যালস কোম্পানিগুলো সরকারকে সহযোগিতা করবে।
নিয়ম তৈরি হলেও তা মানা হয় না উল্লেখ করে ক্যানজুমার অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে অনুষ্ঠানে বলা হয়, ‘১৯৯৮ সালে আইন করা হলেও ২০২৩ সালে ওষুধের সঙ্গে কসমেটিকস রাখার আইন পাস হয়েছে। ওষুধের দাম বেড়ে যাওয়ার প্রবণতা সীমাহীন পর্যায়ে চলে যাচ্ছে। এটিকে কীভাবে নিয়ন্ত্রণের আওতায় আনা যায় সেটি ভেবে দেখতে হবে। কোম্পানিগুলো যেভাবে এগোচ্ছে তাতে তারা গণশত্রুতে পরিণত হবে। যারা ব্যবসা করছেন, তাদের লাভ হচ্ছে বলেই তারা ব্যবসা করছেন।
ওষুধের দাম সীমাহীন পর্যায়ে চলে যাচ্ছে উল্লেখ করে ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সাংগঠনিক সম্পাদক সৈয়দ মিজানুর রহমান বলেন, ছুরি ধরার মতো ওষুধ কোম্পানিগুলোর ক্যাডার বাহিনী তৈরি হয়েছে, যাদের আচরণ গণশত্রুর মতো।
আলোচনার এক পর্যায়ে সভায় উত্তেজনা দেখা দেয়। ওষুধ কোম্পানিগুলোর পক্ষ থেকে বলা হয়, তথ্য-উপাত্ত ঠিকভাবে না জেনে ওষুধশিল্প ও এর অবদান বিষয়ে অনেকেই কথা বলেন। ওষুধশিল্প এখন প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে।
ওষুধ কোম্পানি এক্মির চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান সিনহা বলেন, বাংলাদেশের কোনো কোম্পানি নিম্নমানের ওষুধ তৈরি করে না।
ওষুধ উৎপাদনে যাওয়ার আগে ৪৯ ধরনের লাইসেন্স বা নিবন্ধন নেওয়ার দরকার হয় উল্লেখ করে ডেল্টা ফার্মার ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ জাকির হোসেন বলেন, বায়োলজিক্যাল পণ্য তৈরির একটি বড় চ্যালেঞ্জ সামনে আসছে।
অত্যাবশ্যকীয় ওষুধের তালিকা হালনাগাদ করার পরামর্শ দিয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ন্যাশনাল প্রফেশনাল অফিসার অনিন্দ্য রহমান বলেন, মানুষ ১০ শতাংশ ওষুধ হাসপাতাল থেকে নেয়, ৯০ শতাংশ ওষুধ নেয় দোকান থেকে। মানুষ অযৌক্তিকভাবে অ্যান্টিবায়োটিক ও সাধারণ ওষুধের ব্যবহার করে।
বিশ্বব্যাংকের জ্যেষ্ঠ অর্থনীতিবিদ (স্বাস্থ্য) আতিয়া হাসান বলেন, অত্যাবশ্যকীয় ওষুধের তালিকায় পরিবর্তন এনে তাতে অসংক্রামক রোগের ওষুধ অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। ভোক্তাদেরও ওষুধ ব্যবহারের ক্ষেত্রে আচরণ পরিবর্তনের দরকার আছে।
সরকারের একমাত্র ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান এসেনসিয়াল ড্রাগস কোম্পানি লিমিটেডের (ইডিসিএল) সক্ষমতা বাড়ানোর কথা বলেন একাধিক আলোচক। একজন বলেন, ওষুধ প্রতিনিধিদের পেছনে ব্যয় না করলে ওষুধের দাম কমবে।
নির্দিষ্ট একটি ওষুধের নাম উল্লেখ করে নাগরিক সংগঠন সুস্বাস্থ্যের বাংলাদেশের আহ্বায়ক কাজী বেননূর বলেন, একই ওষুধ কোম্পানিভেদে দাম ১০ টাকা ও সাড়ে ১৭ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। শীর্ষ ১০ কোম্পানির ওষুধই ভালো, তার নিশ্চয়তা নেই।
অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নূরজাহান বেগম বলেন, ‘আমাদের মধ্যে পক্ষ-বিপক্ষ বলে কিছু নেই। আমাদের প্রত্যেকের দরিদ্র আত্মীয়-স্বজন আছে। আমাদের এমন কিছু করতে হবে, যেন কেউ বলতে না পারে যে আমার ওষুধ কেনার সামর্থ্য নেই।’
এসেনসিয়াল ড্রাগস কোম্পানি লিমিটেডকে (ইডিসিএল) বিশ্বমানের একটি প্রতিষ্ঠানে পরিণত করতে সবার সহায়তা প্রয়োজন বলে জানান তিনি।
স্বাস্থ্য উপদেষ্টা বলেন, ‘আমাদের প্রত্যেককেই কম বেশি ওষুধ খেতে হয়। আমরা ব্যবসা করবো, লাভও করবো। কিন্তু মানুষের কথা সবার আগে মাথায় রাখতে হবে।’
অনুষ্ঠানে অন্যদের মধ্যে বক্তব্য দেন রেনেটার ব্যবস্থাপনা পরিচালক কায়সার কবির ও ইউএসএআইডির প্রকল্প ব্যবস্থাপক লিজা তালুকদার এবং বাংলাদেশ হেলথ ওয়াচের কর্মসূচি পরিচালক শেখ মাসুদুল আলম।