মেডিভয়েস রিপোর্ট: অমর একুশে গ্রন্থমেলায় প্রকাশিত হয়েছে চিকিৎসক ডা. আশরাফ জুয়েলের কাব্যগ্রন্থ ‘কবিরা আজীবন বিরোধী দল’। বুনন প্রকাশন থেকে প্রকাশিতব্য গ্রন্থটিতে ৫২টি কবিতা স্থান পেয়েছে। শুক্রবার (১৪ ফেব্রুয়ারি) থেকে গ্রন্থমেলার ৩৫৬ নম্বর স্টলে পাওয়া যাবে কাব্যগ্রন্থটি।
সময়ের চরিত্র অঙ্কন করার প্রয়াস পাওয়া কবি আশরাফ জুয়েল চেয়েছেন কবিতাগুলো যেন মানুষের সামনে আয়না হয়ে ধরা দেয়। কোনো না কোনো ভাবে মানুষ নিজেকে সে আয়নায় দেখতে পাবে এবং তা থেকে মুক্তির প্রয়াস পাবে—এই প্রত্যাশা তাঁর।
গ্রন্থমেলার বুনন প্রকাশনের স্টল ছাড়াও প্রথমা ডট কম এবং রকমারি ডট কম থেকে ঘরে বসেই বইটি অর্ডার করা যাবে।
কবিতায় সময়কে ধারণ করার প্রয়াস
আশরাফ জুয়েল কবিতার মাধ্যমে সময়কে ধারণের প্রয়াস চালিয়েছেন। তাঁর মতে, প্রকৃত কবিরা সত্য কথা বলার চেষ্টা করেন। তার অনুভূতি, মানুষের বলতে না পারার কথা এবং মানুষের ব্যক্তিগত অনুভুতি কবিরা বলার চেষ্টা করেন। এটি কবিরই ব্যক্তিগত অনুভুতি, কিন্তু সে অনুভূতি যখন মানুষের সাথে মিলে যায়, তখন সেটি কবিতা হয়ে উঠে। সেই লেখাগুলো মানুষের লেখা হয়ে উঠে, সমাজের দর্পণ কিংবা দলিলে পরিনত হয়।
তিনি বলেন, ‘আমি চেয়েছি বর্তমান সময়ের চরিত্র আঁকতে, যে চরিত্রে ভবিষ্যতের মানুষ, ভবিষ্যতের সময় ও সমাজ হয়ত ভবিষ্যত কালকে চিত্রিত করার প্রয়াস পাবে।’
আশরাফ জুয়েলের ভাষ্য, ‘প্রধানত সত্য হলো ব্যক্তিগত সত্য। অর্থাৎ আপনি যেটিকে সত্য বলে জানেন, সেটি একান্ত আপনার ব্যক্তিগত। সেই সত্য যদি জনসম্মুখে প্রকাশ পায়, তখন সেটি সত্য থাকে না, হয়ে উঠে তথ্য। দিনে দিনে সে তথ্যগুলো হয়ে উঠে জনগনের চরিত্রের একটি অংশ। আর সত্য যদি তার অবয়ব আরও হারিয়ে ফেলে, তখন সর্বনিকৃষ্ট অবস্থায় সেগুলো যায়—কেবলমাত্র স্লোগানে পরিনত হয়। কিন্তু কবিতা তো স্লোগান নয়। কবিতা হচ্ছে সেই ব্যক্তিগত সত্য, সে সত্যের জায়গায় আমার বিশ্বাসকে সামনে রেখে অনুভূতিগুলো প্রকাশ করেছি।’
সময় একটি চরিত্র নির্মান করে নিয়েছে বলে মনে করেন কবি আশরাফ জুয়েল। তিনি বলেন, ‘সে চরিত্রের ভিত্তিতে মানুষ, সমাজ, রাষ্ট্র, রাষ্ট্রক্ষমতা ও সংবিধানের সঙ্গে যে আচরণ করা উচিত ছিল সময়ের, সে আচরণের বাইরে গিয়েও এক ধরনের বৈরী আচরণ করছে। এই বৈরিতার ফলে দেশে দেশে মানুষের প্রতি অত্যাচার-নিপীড়ন, মানুষ যে নিগৃহীত হচ্ছে, তার মৌলিক অধিকার তো পরে—সামান্য অধিকারটুকুও পাচ্ছে না, তার ব্যক্তিগত গোপনীয়তা বলে কিছু থাকছে না; মানুষের প্রতি সময়ের যে বঞ্চনা—আমি ঠিক এই জায়গাগুলোকে স্পষ্ট করেছি কাব্যটিতে।’
লেখক মনে করেন, গ্রন্থের কবিতাগুলো পড়লে মানুষের প্রতি নিপীড়ন-অত্যাচার ও বঞ্চনা থেকে উত্তরণের একটি রাস্তা নির্মাণ করা সম্ভব।
নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র: মহাকাব্যিক অভিজ্ঞান
উচ্চ মাধ্যমিকে অধ্যয়নকালে সাহিত্য প্রতিভা প্রকাশ পায় আশরাফ জুয়েলের। মেডিকেলে ভর্তির পর ছন্দপতন ঘটলেও পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়নি। তবে প্রতিভার বিকাশ শুরু হয় ২০১৪ সালে। ততদিনে তিনি পূর্ণাঙ্গরূপে থিতু হয়েছেন চিকিৎসা পেশায়। বর্তমানে প্রায় ২০ বছর ধরে ক্রিটিক্যাল কেয়ার ইউনিট বা নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে কর্মরত তিনি। চিকিৎসক এবং লেখক সত্ত্বার পৃথকীকরণের প্রচেষ্টা থাকলেও নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে মানবিক যে করুণকাব্য নিত্যদিন রচিত হয়, তা সাহিত্য সাধনায় প্রেরণা জোগায় তাঁকে।
তাঁর ভাষ্য—‘মানুষ মাত্রই লেখক; তার চিন্তা, স্মৃতি, ভবিষ্যত পরিকল্পনা সব সময় মস্তিষ্ক বা হৃদয়ের খাতায় লিপিবদ্ধ করতে থাকেন। সেটিকে কেউ কাগজের বইয়ে প্রকাশ করেন, কেউ করেন না।’
আশরাফ জুয়েল বলেন, ‘আমি চেষ্টা করি, চিকিৎসার সাথে আমার লেখক সত্ত্বাকে আলাদা রাখার। কিন্তু সেটি সব সময় সম্ভব হয় না। উপরন্তু, আমি কাজ করি ইনটেনসিভ বা ক্রিটিক্যাল কেয়ার ইউনিটে। এখানে মরণোন্মুখ মানুষ জীবনের আশায়, বাঁচার আশায় আসে। তাদের এবং আত্মীয়-স্বজনের যে তীব্র আকুতি, বেঁচে থাকার জন্য যে প্রবল আকাঙ্ক্ষা, সে আকাঙ্ক্ষা প্রতিদিন প্রতিটি রোগীর পাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমি দেখি। আমার কাছে মনে হয়, এগুলো একেকটা মহাকাব্য হওয়ার মতো, বড় উপন্যাস হওয়ার মতো। আমার মনে হয়, সে সব জায়গা থেকে লেখালেখির কিছু স্পৃহা পাই।’
কবি বলেন, ‘আমরা নিজেদের জীবনটাকে খুব সহজ, সস্তা মনে করি। কিন্তু সৃষ্টিকর্তা মানুষকে শ্রেষ্ঠ জীব হিসেবে তৈরি করেছেন। প্রত্যেকের কিছু দায়িত্ব দিয়ে পাঠিয়েছেন। সে দায়িত্ব আমরা পালন করতে পারি না। আমরা খুব অবহেলায় অনেক সময় জীবনের সাথে খুব অন্যায় আচরণ করি। জীবনকে আমরা খুব সহজভাবে দেখি। জীবনের গুরুত্বটা অনেক সময় বুঝতে পারি না। বাচার আকুতি নিয়ে কতো মানুষ আসে আইসিইউ-তে। এসব রোগীরা আমার লেখার চমৎকার উপাদান এবং উৎসাহ হিসেবে কাজ করেছে।’
পেশাগত জীবনের বাইরেও রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নও গভীর দাগ রেখেছে ডা. আশরাফ জুয়েলের রচনায়। এক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা তাঁর রচনাকে করেছে শাণিত। ২০১৭ সালে প্রকাশ পাওয়া তাঁর প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘রাষ্ট্রধারণার বিরুদ্ধে মামলা ও বিবিধ গল্প’। গ্রন্থের গল্পগুলোর পেছনে রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন প্রেরণা হিসেবে কাজ করে। সেইসময় পেট্রোল বোমার আগুনে ঝলসে যায় লেখকের মায়ের শরীর। দীর্ঘদিন যন্ত্রণা ভোগ করেছেন তিনি, এখনও কিছুটা বিকৃত লেখকের মমতাময়ী মায়ের মুখ। সে বেদনা থেকেই ওই গল্পগুলো লেখা। এ গ্রন্থের পাণ্ডুলিপিটি সেই সময়ে জেমকন তরুণ সাহিত্য পুরষ্কারে ভূষিত হয়।
কবি পরিচিতি
ডা. আশরাফ জুয়েলের জন্ম ১৯৭৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে, চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা সদরের মহারাজপুর গ্রামে। বাবার ব্যাংকে চাকরিসূত্রে বদলিজনিত কারণে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনার পর চাঁপাইনবাবগঞ্জের প্রখ্যাত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হরিমোহন সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন তিনি। এরপর রাজশাহী কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক সম্পন্ন করে চিকিৎসা পেশায় যুক্ত হওয়ার স্বপ্নে ভর্তি হন বগুড়ার শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ। এমবিবিএস সম্পন্ন করার পর ২০০৫ সালে ঢাকায় এসে বারডেম হাসপাতালে চাকরি শুরু করেন। এরপর বিভিন্ন হাসপাতাল ঘুরে বর্তমানে ইউনাইটেড হাসপাতালে কর্মরত রয়েছেন। প্রায় ২০ বছর ধরেই নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রেই কর্মরত তিনি।
চিকিৎসা পেশাকে ‘সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত সুযোগ’ মনে করা আশরাফ জুয়েলের নেশা লেখালেখি। ২০১৪ সালে সাহিত্য সাধনায় মনোনিবেশ করেন। সে বছর প্রকাশ পায় তাঁর মলাটবদ্ধ প্রথম গ্রন্থ ‘যুদ্ধ ছাড়া শুদ্ধতা অসম্ভব’। এরপর একে একে সাতটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। এর মধ্যে চারটি কাব্যগ্রন্থ। প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘রাষ্ট্রধারণার বিরুদ্ধে মামলা ও বিবিধ গল্প’ জেমকন তরুণ কথাসাহিত্য পুরস্কারে ভূষিত এবং পাঠক ও সমালোচক মহলে সমাদৃত। পশ্চিমবঙ্গ থেকে পেয়েছেন ‘ইতিকথা মৈত্রী সাহিত্য সম্মাননা-২০১৭’। তিনি ‘পূর্বপশ্চিম সাহিত্য পত্রিকা’র প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক।
ব্যক্তি জীবনে আশরাফ জুয়েল দুই সন্তানের জনক। তাঁর সহধর্মিনী ডা. রওশন আরা খানম ইউনাইটেড হসপিটারেল বক্ষব্যাধি বিশেষজ্ঞ।
এনএআর/