শনিবার দুপুর, এখানে ছুটির দিন। দুপুরে খেয়ে এক কাপ চা বানিয়ে টিভিটা ছেড়েছি, ঠিক তখনই দেশ থেকে ম্যাসেঞ্জারে ফোন।
এক জুনিয়র, ভালো ডাক্তার। সামনে মেডিসিনের একটি শাখায় এমডি পরীক্ষায় বসবে, প্রস্তুতি নিচ্ছে। আমি আন্তরিক হাসি দিয়ে বললাম, ‘আহা, ভবিষ্যতের স্পেশালিস্ট! কংগ্র্যাটস!’ সে ছোট্ট একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, ‘ভাইয়া, দোয়া করবেন। এই সিম্পল এমবিবিএস শব্দটা এখন আর ভালো লাগে না। শ্বশুরবাড়িতেও জিজ্ঞেস করে, কিসের স্পেশালিস্ট?’
ঘটনা-২
আমার এক চিকিৎসক বন্ধু কিছুদিন মেডিসিনে ট্রেনিং করেছিল। এখন এলাকায় জেনারেল প্র্যাকটিস করে। নামের পাশে কিছু পি-১, পিজিটি, সিসিডি, ডিএমইউ ধরনের সংক্ষিপ্ত ডিগ্রি থাকলেও মূলত সে তথাকথিত স্কেলে একজন ‘সিম্পল এমবিবিএস’। আমি তার চেম্বারে গিয়েছিলাম। ঢাকা শহরের একজন সাধারণ এমবিবিএস ডাক্তার হিসেবে তার প্র্যাকটিস সত্যিই আকর্ষণীয়, এমনকি ঈর্ষণীয়ও।
সে সকাল-সন্ধ্যা দুটি চেম্বারে প্র্যাকটিস করে। একটু ধর্মভীরু মানুষ। লাইফস্টাইলে গুরুত্ব দেয়, পরিবার আর বাচ্চাকে সময় দেয়। কম লোভী মানুষ। একজন প্রফেশনাল, অমায়িক এবং রোগীকে সময় দেওয়া চিকিৎসক। সবচেয়ে বড় কথা, সে নিজের সীমাবদ্ধতা জানে। সে বলে, ‘যেটা বুঝি না, রোগীকে সরাসরি বলি—দুঃখিত, এটা পুরোপুরি আমার জানা নেই। আমি আপনাকে অন্য ডাক্তারের কাছে পাঠাচ্ছি।’
আমি অবাক হয়ে বললাম, ‘বলিস কি! বাংলাদেশের রোগীকে এমন কথা বললে তো প্র্যাকটিস লাটে উঠবে!’ সে হেসে বলে, ‘না দোস্ত, বরং উল্টোটা হয়। রোগীরা আমাকে বেশি বিশ্বাস করে।’
সে সকাল ১০টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত, আবার সন্ধ্যা ৬টা থেকে রাত ১০টা-১১টা পর্যন্ত চেম্বার করে। গত ডিসেম্বরে বলছিলো, ‘প্রতিদিন ৫০-এর বেশি রোগী দেখি। ১১টার পর আর দেখি না। চাইলে আরও পাঁচজন দেখা যেত। কিন্তু আমি খুশি। আলহামদুলিল্লাহ।’
আমি চমকে উঠেছিলাম। ঢাকার অনেক বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের চেম্বারেও নিয়মিত ৫০ জন রোগী হয় না। আমার কিছু বন্ধু আছে, যাদের চেম্বারে প্র্যাকটিস নেই বললেই চলে। তারা ঢাকার বাইরে গিয়ে খণ্ডকালীন প্র্যাকটিস করেন—পেট তো চালাতে হবে।
আমি আমার সেই সিম্পল এমবিবিএস বন্ধুকে বললাম, ‘তুই মেডিসিনে ডিগ্রি করিস না কেন?’
- ‘দোস্ত, আমি জেনারেল প্র্যাকটিসই করতে ভালোবাসি।’
- ‘তুই যা করিস, অস্ট্রেলিয়াতে পারফেক্ট একজন জনপ্রিয় জিপি (জেনারেল প্র্যাকটিসনার) হবি। ওখানে জিপিরাই এই কাজ করে।’
সে বলেছে, ভেবে দেখবে। আপাতত তার দেশের জীবনযাপনই ভালো লাগছে।
এবার মূল গল্পে আসি। এই সিম্পল এমবিবিএস বনাম কমপ্লেক্স এমবিবিএস সমস্যার মূল সূত্র কোথায়? উত্তর—দেশে জেনারেল প্র্যাকটিস ও ইমার্জেন্সি মেডিসিন বিষয় দুটির অনুপস্থিতি। যার ফলে বিশাল সংখ্যক চিকিৎসক সমাজকে কমপ্লেক্স এমবিবিএসের পেছনে দৌঁড়াতে বাধ্য করা হচ্ছে। উন্নত দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থা দাঁড়িয়ে আছে দুটি ভিত্তির উপর—
১. জেনারেল প্র্যাকটিস
২. ইমার্জেন্সি মেডিসিন
একজন সাধারণ মানুষ মাথাব্যথা থেকে ক্যান্সার—সবকিছুর জন্য প্রথমে জিপির কাছে যান। সেখানে রেফারেল থেকে শুরু করে ফলো আপ ও বিশেষজ্ঞের সাথে যোগাযোগসহ সবকিছু ম্যানেজ করেন জিপি। সাথে তার প্রাথমিক সেবা তো আছেই। আর জরুরি মুহূর্তে রোগী যান ইমার্জেন্সিতে। সেখানে রোগীকে স্টেবিল করে প্রয়োজন হলে বিশেষজ্ঞ ডাক্তার যুক্ত করা হয়। এরপর ডিসচার্জ হয়ে আবার রোগী ফিরে যান জিপির কাছে। এই সম্পূর্ণ সিস্টেমটা দেশে নেই। আমাদের দেশে রোগী সরাসরি যান বিশেষজ্ঞের কাছে।
পেটে ব্যথা মানেই সার্জনের কাছে, মাথা ব্যথা মানেই নিউরো চিকিৎসকের কাছে, কাশি মানেই বক্ষব্যাধি চিকিৎসকের কাছে। ইমার্জেন্সি বা জিপির কোনও ভূমিকা নেই। সার্জারির কিছু ব্রাঞ্চ বাদ দিলে দেশের বাকি বিশেষজ্ঞের চেম্বারের ৯৮ শতাংশই জেনারেল রোগী। আপনি বিখ্যাত অধ্যাপক দীন মোহাম্মদের চেম্বারে যান, ৩০০ রোগীর মধ্যে ২০০ জনই টেনশন টাইপ হেডেক অথবা স্ট্রোক কি মোটর ডিজিজের ফলোআপে এসেছে, যেগুলো জিপির কাজ।
এর ফলে যেসব সমস্যা হচ্ছে—
- জরুরি রোগী সঠিক সময়ে সঠিক চিকিৎসা পাচ্ছে না
- স্পেশালিস্ট চিকিৎসকদের দক্ষতা হারাচ্ছে কারণ অধিকাংশ রোগীই জেনারেল
- রোগীরা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত
- ডাক্তারদের উপর রোগীর আস্থা কমে যাচ্ছে
- চিকিৎসা ব্যবস্থায় বিভ্রান্তি ও হতাশা তৈরি হচ্ছে
একই সাথে আজকে চিকিৎসক সমাজ দুইভাগে বিভক্ত। ১. সিম্পল এমবিবিএস, যার কোনও পোস্টগ্র্যাজুয়েট ডিগ্রি নেই এবং ২. কমপ্লেক্স এমবিবিএস, যার পোস্টগ্র্যাজুয়েট ডিগ্রি আছে। অথচ এই বিভাজন অপ্রয়োজনীয়—যদি জিপি ও ইমার্জেন্সি ব্রাঞ্চ যথাযথভাবে থাকত। উন্নত দেশগুলোতে এক বিশাল সংখ্যক ডাক্তার এই দুটি শাখায় থেকেই চিকিৎসাসেবায় নেতৃত্ব দিচ্ছেন।
একটি উদাহরণ দেই—অস্ট্রেলিয়ার ২০২৩-২৪ সালের তথ্য অনুযায়ী মোট ডাক্তার এক লাখ ৪২ হাজার। এর মধ্যে প্রায় ৫০% স্পেশালিস্ট, তাদের অর্ধেকই আবার জিপি স্পেশালিস্ট। বাকিদের মধ্যে অনেকে ইমার্জেন্সি, সাইকিয়াট্রি, পেডিয়াট্রিক্স ইত্যাদিতে স্পেশালিস্ট। আর বাকি ৫০% নন-স্পেশালিস্ট, যাদের মধ্যে অর্ধেকই আবার জিপি বা ইমার্জেন্সি মেডিসিনে। অর্থাৎ, চিকিৎসা ব্যবস্থায় জিপি ও ইমার্জেন্সি মেডিসিনের গুরুত্ব সবচেয়ে বেশি। কিন্তু আমাদের দেশে এই বিশাল সংখ্যক চিকিৎসক কোথায় যাবে? তাদের জন্য কলেজ কোথায়? ডিগ্রি কোথায়?
ফলে এই ‘সিম্পল এমবিবিএস’ নামক বিশাল জনগোষ্ঠীকে আমরা হতাশ করছি। তাদের সিম্পল এমবিবিএসের তকমা দিয়ে নিজ শ্রেণিকে নিজেরাই অপমান করছি। এই অপমান এড়াতে এরা খেয়ে না খেয়ে বছর বছর কোচিং করে অন্য সাবজেক্টের পোস্ট গ্রাজুয়েশন পরীক্ষায় ভীড় বাড়াচ্ছে। কোন মানে হয়?
আমি অস্ট্রেলিয়াতে শুরুর দিকে ইমার্জেন্সি মেডিসিনের রেজিস্ট্রার ছিলাম। একবার দেশে একজন অধ্যাপককে বলতে শুনেছি, ইমার্জেন্সি মেডিসিন তো সবাই পারে, এর জন্য আলাদা স্পেশালিটি কেন? এমবিবিএসে একিউট এজমার ম্যানেজমেন্ট আর ট্রমাতে সার্জারী লাগে, এইটুকুর জন্য আলাদা স্পেশালিস্ট ব্রাঞ্চ করে শেখানোর কি আছে? আমি কোনো উত্তর দিতে পারিনি। লজ্জায় আমার মাথা কাটা গেছে। মনে হয়েছে, উত্তর দেওয়া অর্থহীন। আমি হাসিমুখে মেনে নিয়েছি। বাংলাদেশে যিনি অধ্যাপক হয়েছেন, তিনি অবশ্যই অনেক জ্ঞানী। আধুনিক পৃথিবীই হয়তো ভুল।
বলুন তো, জিপি ও ইমার্জেন্সি ছাড়া কি একজন স্পেশালিস্ট আসলেই কাজ করতে পারে? পারে না। আপনি স্পেশালিস্ট হয়ে হার্ট ট্রান্সপ্ল্যান্ট করে ফেলতে পারেন, কিন্তু এর পরে রোগীর দীর্ঘমেয়াদি ফলোআপ, রুটিন স্বাস্থ্যসেবা এবং হোলিস্টিক কেয়ার কে দিবে? সেটা একজন স্পেশালিস্ট কিভাবে দিবেন? জিপি ছাড়া সম্ভব?
রাতে হঠাৎ জরুরি অসুস্থতায় রোগী যদি হাসপাতালে যায়, আপনি কি সরাররি স্পেশালিস্ট লাং সার্জনকে ফোন করবেন? সে এসে রোগীর ওয়ার্ক-আপ করবে? হার্ট-লাং সার্জন তো হার্ট-লাংস এর বাইরে রোগীর যে ইউরিন ইনফেকশন হতে পারে সেটাই মিস করবেন। কারণ সিম্পল, এটি তার প্রাকটিস ফিল্ড না। তিনি রিসাসেটেশন কিভাবে করবেন? হ্যা, তিনি এমবিবিএস বইয়ে পড়েছেন। ওই তর্কে তাহলে এমবিবিএসে সবই পড়ানো হয়, সবাই সব করুক। এত ব্রাঞ্চের দরকার কি?
দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা আগাচ্ছে না। রোগীর ভরসার জায়গাটি কম। একটু সামর্থ্য থাকলেই রোগী বিদেশমুখী। আজকে দেশের চিকিৎসকগণ যখন নিজে রোগী হন, তখন তাঁরাও বিদেশে চিকিৎসা নিতে যান, কারণ আস্থা নেই। আত্মীয়-স্বজন কিংবা বন্ধু-বান্ধবের কাছে সবচেয়ে বেশি কোন ফোন পান? ‘দোস্ত, কোন ডাক্তার দেখাবো?’—এই তো? এটাই জিপির কাজ। জিপির কাজ ফোনে করেন আপনি।
আমার ফেসবুকে চিকিৎসক বন্ধুদের প্রায় সবাই ডিগ্রি শেষ করে একেকটি ব্রাঞ্চে স্পেশালিস্ট। চেম্বারের কার্ড, সাফল্যময় চিকিৎসার ছবি ও প্রচার অহরহ। আমি বিশ্বাস করি—একেকজন হয়তো ভবিষ্যতের কিংবদন্তি দীন মোহাম্মদ, টিআই চৌধুরী, এমআর খান ফজলুল হক কিংবা মোমিনুজ্জামান হবেন। কিন্তু দেশ কি পাল্টাবে? স্বাস্থ্য ব্যবস্থার কি উন্নতি হবে? রোগীর কি চিকিৎসা সেবায় অ্যাক্সেস বাড়বে? সার্ভিস ডেলিভারি বাড়বে? সে কি ইনটিগ্রেটেড চিকিৎসা, হোলিস্টিক অ্যাপ্রোচ, টোটাল কেয়ার—এইসব বিদেশি কেতাবি শব্দের মুখ কোনদিন দেখবে? কিংবা রোগীদের বিদেশমুখীতা কি কমবে? রোগীদের ভরসার জায়গাটি কি বাড়বে?
এটা নিশ্চিত, আজকের কমপ্লেক্স এমবিবিএস করা ভবিষ্যতের ফজলুল হক কিংবা মোমিনুজ্জামানদের একেকজনের ধানমন্ডি-বনানী-গুলশান-বারিধারায় বিঘা কিংবা একরের উপর একাধিক বাড়ি হবে, একাধিক মার্সিডিজ গাড়ি হবে। গুটিকয়েক সুপার কমপ্লেক্স এমবিবিএসদের গাড়ি-বাড়িটা মূল সমস্যা না। কিন্তু এই গুটিকয়েক কমপ্লেক্স এমবিবিএসের ঘোড়দৌঁড়ে সিম্পল এমবিবিএসরা ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌঁড়াচ্ছে, সাবজেক্ট না থাকার কারণে হারিয়ে যাচ্ছে। এটা স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ক্ষতি, এটা সমস্যা।
দশজন লিজেন্ডারি দীন মোহাম্মদ দিয়ে কোনোদিনও ১৮ কোটি জনসংখ্যার দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার সামগ্রিক উন্নতি হবে না। শূন্যের উপর প্রাসাদ নির্মাণ করা যায় না, তা ভঙ্গুরই হয়। এ কারণে বিল্ডিংয়ের নিচে ফাউন্ডেশন দিতে হয়। আমরা ফাউন্ডেশন দিচ্ছি না, ইমারত তুলে যাচ্ছি। সুপার স্পেশালিস্ট ইনস্টিটিউট বানাচ্ছি। বিদেশ থেকে শত কোটি টাকার উন্নত মেশিন আনছি, রোবটিক সার্জারির যন্ত্র আনছি। এসব খুবই ভালো কথা। কিন্তু সুপার স্পেশালিস্ট কাজ করে ক্যান্সারের রোগীটা যে হাসপাতাল থেকে ডিসচার্জ দিবেন, ফেরত যে পাঠাবেন জিপির কাছে, সেই জিপি সিস্টেমটা কই?
এনএআর/