আমাদের দেশ থেকে প্রতি বছর বিশ হাজারের অধিক রেজিস্টার্ড নার্স ও মিডওয়াইফ তৈরি হচ্ছে, যেটি সঠিকভাবে কাজে লাগিয়ে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন সম্ভব। পার্শ্ববর্তী দেশ যেমন–ভারত ও নেপালসহ তৃতীয় বিশ্বের অনেক দেশ এই ক্ষেত্রে সফল।
এই ক্ষেত্রে একই পদ্ধতি, একই সিলেবাসে পড়াশোনা করেও তাদের তুলনায় আমরা পিছিয়ে আছি। এ অবস্থায় কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নিতে পারলে আমাদের নার্সরা দেশে-বিদেশে ক্যারিয়ার গঠনের একটি স্বচ্ছ ধারণা পাবে। দেশের অর্থনীতি সমৃদ্ধকরণে ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে।
আমরা মনে করি, দেশে কাজ করার পাশাপাশি বিভিন্ন দেশে পাঁচ-দশ বছর কাজ করে দক্ষ হয়ে ফিরে অনেক নার্স জনগণকে উন্নত সেবা দিতে পারবে।
বিষয়টি পরিষ্কার করতে নিচে কিছু তথ্য প্রদান করা হলো, যা পার্শ্ববর্তী ভারতসহ বিভিন্ন দেশের নার্সদের বহির্বিশ্বে নিয়োগের ব্যাপারে স্বচ্ছ ধারণা দেবে।
যুক্তরাষ্ট্র: যুক্তরাষ্ট্রে বিদেশি নার্সদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ফিলিপিনো নার্স, এরপর ভারতীয় নার্স। সেখানে মোট ৩৪ লাখ নার্সের মধ্যে প্রায় ৬ লাখ (১৬%) প্রবাসী নার্স, যার মধ্যে দেড় লাখ ফিলিপিনো এবং ৩২,০০০ ভারতীয়, যা মোট প্রবাসী নার্সের ৬ শতাংশ; এরপর নাইজেরিয়ার আছে প্রায় ২৫,০০০ নার্স।
জার্মানি: গত ২৫-২৬ অক্টোবর জার্মান চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎস ভারতে এসে প্রধানমন্ত্রী মোদির সাথে প্রায় ৯০,০০০ দক্ষ শ্রমিক প্রেরণের চুক্তি করেন, যার মধ্যে নার্সরাও অন্তর্ভুক্ত। জব ফেয়ারের মাধ্যমে আগ্রহীদের সরকারিভাবে ভাষা শিক্ষা দিয়ে জার্মানি প্রেরণ করা হচ্ছে।
যুক্তরাজ্য: যুক্তরাজ্যে প্রবাসী নার্সদের মধ্যে সর্বাধিক ভারতীয়, যা সংখ্যায় ৫৬,০০০। ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান নার্স এসোসিয়েশনের মাধ্যমে প্রতি বছর ৫,০০০ নার্স যুক্তরাজ্যে প্রেরণের পরিকল্পনা রয়েছে। সেখানে তাদের অবস্থান এতটাই দৃঢ় যে, একজন ভারতীয় নার্স ব্রিটিশ সংসদ সদস্যও নির্বাচিত হয়েছেন।
জাপান: মেঘালয় রাজ্য সরকার গত অক্টোবর জাপানে ২৭ জন নার্স পাঠিয়েছে। জব ফেয়ারের মাধ্যমে আগ্রহীদের নির্বাচন করে রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে ভাষা প্রশিক্ষণসহ সকল সহযোগিতা প্রদান করা হয়েছে।
সিঙ্গাপুর: সিঙ্গাপুরেও সরকারি সহযোগিতায় জব ফেয়ারের মাধ্যমে নার্স প্রেরণ করা হচ্ছে। বর্তমানে প্রায় ৬০০ ভারতীয় নার্স সিঙ্গাপুরে কাজ করছেন।
সৌদি আরব: সৌদি আরবে মোট নার্সের ৩০ শতাংশ বিদেশি। বেশিরভাগ ইন্ডিয়ান, মালয়েশিয়ান এবং ফিলিপিনো। ২০১৪ সালের ৫ জুন একবারে ১ হাজার ৮০০ ভারতীয় নার্স নিয়োগ দিয়েছিল সৌদি আরব। ভারতে প্রোমেট্রিক সেন্টার থাকায় ব্যাপক সংখ্যক নার্স সৌদি আরবে যাওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন।
কুয়েত: ২৫,০০০ এর বেশি ভারতীয় নার্স ও ডাক্তার কুয়েতে কাজ করছে, যেখানে আমাদের ১,০০০ ও পাঠানো সম্ভব হয়নি।
অস্ট্রেলিয়া, কানাডা ও নিউজিল্যান্ডসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশেও ভারতীয় নার্স সফলতার সাথে কাজ করছে। শুধু ভারত নয়, প্রতিটি উন্নয়নশীল দেশই এখন বাইরে নার্স প্রেরণ করছে। ফিলিপাইন থেকে প্রতি বছর প্রায় ২০,০০০ নার্স প্রেরণ করা হয়।
এক বছরে ৩ হাজার ১৭৩ নার্স নাইজেরিয়া থেকে শুধুমাত্র যুক্তরাজ্যে গেছেন। যুক্তরাষ্ট্রেও ফিলিপাইন, ভারতের পর তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে তারা, প্রায় ২৫০০০ নার্স যুক্তরাষ্ট্রে কাজ করে।
কয়েকশ’ নার্স একসাথে যুক্তরাজ্যে চলে যাওয়ায় জিম্বাবুয়ের হাসপাতালগুলো নার্স সংকটে পড়েছে, বিষয়টি নিয়ে তাদের মধ্যে আলোচনা হচ্ছে।
আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ নেপালে প্রায় ১,১৬,০০০ নার্স রয়েছে, যাদের এক-তৃতীয়াংশই বিদেশে কাজ করছে। দেশে সংকট থাকলেও সরকার তাদেরকে বাইরে যেতে উৎসাহ দিচ্ছে।
আমাদের বাংলাদেশি নার্সরাও তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর নার্সদের মতোই দক্ষ এবং পরিশ্রমী। সরকার থেকে শুধু একটু সদিচ্ছা ও সার্বিক সহযোগিতা প্রয়োজন। আমাদের নার্সদের বাইরে যেতে আগ্রহী করে তুলতে যা প্রয়োজন–
প্রথমত, NCLEX, CBT/Prometricসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক পরীক্ষা কেন্দ্র বাংলাদেশে স্থাপন করা। চিকিৎসকদের ইউএসএ যাওয়ার পরীক্ষা (USMLE), ইউকে যাওয়ার পরীক্ষা (PLAB, MRCS) কেন্দ্র ঢাকায় থাকলেও নার্সদের জন্য কোনো আন্তর্জাতিক লাইসেন্স পরীক্ষা কেন্দ্র নেই, এমনকি মধ্যপ্রাচ্যের প্রোমেট্রিক কেন্দ্রও নেই।
দ্বিতীয়ত, বাইরের দেশের কর্তৃপক্ষের সাথে কথা বলে সরকারিভাবে জি-টু-জি নিয়োগ পরিচালনা করা এবং জব ফেয়ারের মাধ্যমে বিদেশি নিয়োগকর্তাদের আগ্রহী করা।
তৃতীয়ত, সরকারি উদ্যোগে নির্বাচিত প্রার্থীদের ভাষা শিক্ষার ব্যবস্থা করা এবং আইইএলটিএস, ওইটি, জাপানি, জার্মানি ও আরবি ভাষায় প্রশিক্ষণ কর্মশালা আয়োজন করা।
চতুর্থত, প্রয়োজনীয় পরিমাণে ভর্তুকিসহ সহজ শর্তে ঋণের ব্যবস্থা করা এবং সরকারি চাকরিরত নার্সদের সহজ শর্তে চুক্তিভিত্তিক ছুটির ব্যবস্থা করা।
সর্বশেষ নির্বাচন প্রক্রিয়া থেকে শুরু করে পরীক্ষা, ভিসা প্রসেসিং এবং উত্তীর্ণদের দ্রুত বিদেশ গমনের ব্যবস্থা করা।
আমাদের নার্সরাও যথেষ্ট মেধাবী, দক্ষ ও আগ্রহী। বহির্বিশ্বে স্বাস্থ্যসেবায় নিয়োজিত করতে তাদের একটু সুযোগ ও সহযোগিতা দরকার। আমরা বিশ্বাস করি, সরকারের সদিচ্ছা থাকলে নার্সিং খাত থেকে একদিন আমরা ফিলিপাইনের মতো বছরে ২০,০০০ নার্স বাইরে প্রেরণ করতে সক্ষম হবো।
সুতরাং দক্ষ নার্স বিদেশে পাঠিয়ে রেমিটেন্স বৃদ্ধিতে অবদান রাখুন। এক্ষেত্রে পাশ্ববর্তী দেশগুলো হতে পারে অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত। এ লক্ষ্যে নার্সিং অধিদপ্তরের কর্মকর্তাবৃন্দ, বিভিন্ন সংগঠনের নেতৃবৃন্দ, সচেতন নার্স এক্টিভিস্টদের এগিয়ে আসতে হবে।
এমইউ/