নবাব আব্দুর রহিম: চলতি বছরে বাংলাদেশে ব্যাপক আকারে চিকুনগুনিয়ার প্রাদুর্ভাব হতে পারে বলে সতর্ক করেছেন গবেষকরা। গত ৮ মে সংক্রামক রোগবিষয়ক গবেষণার জন্য পরিচিত ‘ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অব ইনফেকশাস ডিজিসেস রিজিওন্স’ (আইজেআইডি রিজিওন্স) জার্নালে ‘দ্য রিঅ্যাপিয়ারেন্স অব চিকুনগুনিয়া ইন বাংলাদেশ, ২০২৪’ শিরোনামে প্রকাশিত এক গবেষণাপত্রে এ আশঙ্কার কথা জানিয়েছেন তারা।
বিশেষ করে চিকুনগুনিয়ার বাহক এডিস মশার বংশবৃদ্ধির অনুকূল পরিবেশ থাকায় রাজধানীসহ বিভাগীয় শহরগুলোতে ভয়াবহ প্রভাব পড়তে পারে বলে মনে করছেন তারা। সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) তথ্য মতে, ইতোমধ্যে এই বছরের এপ্রিল থেকে চিকুনগুনিয়া আক্রান্ত রোগী শনাক্ত শুরু হয়েছে।
গবেষণাপত্রে যা বলা হয়েছে
২০২৪ সালের ১৯ অক্টোবর থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত আইইডিসিআরে রেফারকৃত ৩৯৪ জন সন্দেহভাজন চিকুনগুনিয়া রোগী নিয়ে পরিচালিত এ গবেষণায় অংশ নিয়েছেন আইইডিসিআর, যুক্তরাজ্যের কিল বিশ্ববিদ্যালয় এবং শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা। তারা সন্দেহভাজন ৩৯৪টি নমুনা থেকে আরটি-পিসিআর পরীক্ষার মাধ্যমে ১৩৮ জন চিকুনগুনিয়া রোগী শনাক্ত করেন এবং ১২টি নমুনার জিনোম সিকোয়েন্সিং করেন। এই রোগীদের ক্লিনিক্যাল এবং এপিওডেমিওলজিক্যাল তথ্য ছাড়াও ফলোআপ তথ্য সংগ্রহ করে বিশ্লেষণ করা হয়।
ফলাফল বিশ্লেষণে জানানো হয়, আক্রান্তদের অধিকাংশই ৩০ বছরের বেশি বয়সের পুরুষ। তাদের উপসর্গ ছিল জ্বর, অস্থিসন্ধিতে ব্যথা, পেশিতে ব্যথা এবং মাথাব্যথা। ৪৭ শতাংশ রোগীর কোনো না কোনো কো-মর্বিডিটি ছিল। ফলোআপকৃত রোগীদের ৮১ শতাংশের ২৮ দিন পরও দীর্ঘস্থায়ী উপসর্গ (জয়েন্ট পেইন) ছিল। এ ছাড়া রোগীরা চিকুনগুনিয়া সংক্রমণের কারণে গড়ে ১০.৫ কর্মদিবস হারিয়েছেন। বাংলাদেশের মাথাপিছু দৈনিক আয় ৬.৯৮ মার্কিন ডলার ধরে প্রত্যেকে গড়ে ৭৩.৩ ডলার আয় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। শনাক্ত হওয়া রোগীদের মধ্যে ১৩৬ জনই ঢাকা শহরের বাসিন্দা। এর মধ্যে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের ৭২ জন এবং উত্তরের ছিলেন ৬৪ জন। ঢাকা সিটির বাইরে দুইজন রোগী ছিলেন, তাদের একজন নারায়ণগঞ্জ, অন্যজন কেরানীগঞ্জের।
গবেষণায় বলা হয়েছে, ২০১৭ সালের পর চিকুনগুনিয়া ভাইরাসের ঢাকায় পুনরায় আবির্ভাব একটি গুরুতর উদ্বেগের বিষয় এবং পর্যাপ্ত ব্যবস্থা না নিতে পারলে আসন্ন ডেঙ্গু মৌসুমে বাংলাদেশের জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার ওপর চরম চাপ সৃষ্টি করতে পারে। একই সাথে এটি মোকাবিলায় সমন্বিত মশক নিধন কার্যক্রম ও আর্বোভাইরাল সার্ভেইলেন্সের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে গবেষণায়।
ইতোমধ্যেই ঢাকায় চিকুনগুনিয়া শনাক্ত শুরু
গবেষণাটি জার্নালে প্রকাশিত হওয়ার আগেই ঢাকাতে নতুন করে চিকুনগুনিয়া আক্রান্ত রোগী শনাক্ত শুরু হয়েছে বলে জানিয়েছেন আইইডিসিআর’র পরিচালক অধ্যাপক ডা. তাহমিনা শিরিন ও বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএমইউ) ভাইরোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. মুনিরা জাহান। এর মধ্যে গত এপ্রিল থেকেই ত্রিশের অধিক রোগী শনাক্ত হয়েছে।
সম্প্রতি চিকুনগুনিয়া শনাক্তের বিষয়ে গবেষণাদলের সদস্য ও আইডিসিআরে কর্মরত ভাইরোলজিস্ট ডা. মো. আব্দুল্লাহ ওমর নাসিফ মেডিভয়েসকে বলেন, ‘সর্বশেষ ২০১৭ সালে বাংলাদেশে বড় আকারে চিকুনগুনিয়া প্রাদুর্ভাব (আউটব্রেক) হয়। সে সময় ঢাকাসহ ১৭টি জেলা থেকে রোগী শনাক্ত হয়েছিল। ওই সময় ডায়াগনোজড কেস ছিল ১৩ হাজারের মতো। কিন্তু একটি মডেলিং স্টাডিতে দেখা গিয়েছে, এ সংখ্যা আরো অনেক বেশি ছিল। ২০১৭ সালের আউটব্রেকটি এপ্রিল মাস থেকে শুরু হয়েছিল। এ বছরও এপ্রিলের তৃতীয় সপ্তাহ থেকেই আমরা নিয়মিতভাবে চিকুনগুনিয়া পজিটিভ রোগী পাচ্ছি। সামনের কয়েকটি মাস, যে সময়টাকে আমরা ডেঙ্গু মৌসুম বলি, সে সময়ে সাধারণত এডিস মশার ব্যাপক বংশবৃদ্ধি ও বিস্তার ঘটে। সুতরাং এখন থেকেই সতর্ক না হলে ঢাকা শহরে ২০১৭ সালের মতো অনেক বড় আকারে প্রাদুর্ভাব হতে পারে। এ ছাড়া সামনের মাসে ঈদে মাস মাইগ্রেশনের সময় সারাদেশে এটা ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কাও রয়েছে।’
চিকুনগুনিয়া পরীক্ষা: প্রস্তুতিহীন বেশিরভাগ হাসপাতাল
চিকুনগুনিয়ায় মৃত্যুর হার কম হলেও বেশ ভোগান্তির মধ্যে পড়তে হয় রোগীকে। অসহনীয় গিট ব্যথায় স্থবির হয়ে পড়ে শরীর। চিকুনগুনিয়ার সুনির্দিষ্ট কোনো প্রতিষেধক বা অ্যান্টিভাইরাল ওষুধ নেই, তাই এর চিকিৎসা মূলত লক্ষণভিত্তিক। এজন্য প্রয়োজন সঠিকভাবে রোগ নির্ণয়। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, র্যাপিড অ্যান্টিবডি টেস্ট এবং আরটি-পিসিআরের মাধ্যমে চিকুনগুনিয়া পরীক্ষা করা হয়।
কিন্তু বেশিরভাগ সরকারি হাসপাতালেই এই পরীক্ষার ব্যবস্থা নেই। যেসব হাসপাতালে ব্যবস্থা আছে, তাও করা হয় র্যাপিড এন্টিবডি টেস্টের মাধ্যমে। শরীরে অ্যান্টিবায়োটিক তৈরিতে পাঁচ থেকে সাতদিন সময় লেগে যায়। ফলে র্যাপিড টেস্ট দিয়ে সাত দিনের আগে সাধারণত রোগ নির্ণয় করা সম্ভব হয় না। কয়েকটি বেসরকারি হাসপাতালে পিসিআর পরীক্ষার ব্যবস্থা থাকলেও উচ্চমূল্যের কারণে তা সাধারণের নাগালের বাইরে। ফলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, আক্রান্তদের চিকিৎসা ব্যবস্থায় গুরুতর সমস্যা তৈরি হতে পারে বলে—যা রোগীর সঠিক চিকিৎসা, জনস্বাস্থ্য এবং রোগ নিয়ন্ত্রণকে প্রভাবিত করবে।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সংক্রামক রোগনিয়ন্ত্রণ শাখার লাইন ডিরেক্টর ডা. মো. হালিমুর রশিদ মেডিভয়েসকে জানান, বেশিরভাগ হাসপাতালে চিকুনগুনিয়া পরীক্ষার কিট নেই। প্রয়োজনে সব হাসপাতালে তারা কিট সংগ্রহ করার জন্য চিঠি পাঠাবেন। তবে অপারেশন প্ল্যান (ওপি) বন্ধ থাকায় তাদের পক্ষ থেকে কিট ক্রয় করে হাসপাতালগুলোতে সরবরাহ করা সম্ভব নয়।
বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই র্যাপিড টেস্ট করা হয় জানিয়ে তিনি বলেন, ‘প্রয়োজনে বিকল্প হিসেবে পিসিআর করা যেতে পারে। পিসিআর মেশিন অনেক হাসপাতালেই আছে, করোনার সময় দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু কিট লাগবে। তা ছাড়া পিসিআরে খরচ একটু বেশি পড়বে।’
বিএমইউতে দুই মাধ্যমেই চিকুনগুনিয়া পরীক্ষা করা হচ্ছে জানিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইরোলজি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. মুনিরা জাহান মেডিভয়েসকে বলেন, ‘এখন চিকুনগুনিয়া রোগী শনাক্ত হচ্ছে। বিএমইউতে র্যাপিড অ্যান্টিবডি টেস্ট এবং আরটি-পিসিআর—দুই উপায়েই পরীক্ষা করা হচ্ছে।’
মশা নিয়ন্ত্রণই প্রতিরোধের প্রধান উপায়
চিকুনগুনিয়ার প্রাদুর্ভাব মোকাবিলায় মশা নিয়ন্ত্রণই প্রতিরোধের প্রধান উপায় বলে জানাচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। এজন্য প্রশাসনিক উদ্যোগের বাইরেও নগরবাসীকে মূল ভূমিকা রাখতে হবে বলে মন্তব্য তাদের।
এ বিষয়ে আইইডিসিআরের পরিচালক অধ্যাপক ডা. তাহমিনা শিরীন মেডিভয়েসকে বলেন, ‘চিকুনগুনিয়ার প্রাদুর্ভাব মোকাবিলায় প্রস্তুতির বিষয়টি একা আইইডিসিআর কিংবা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নয়। এর প্রস্তুতি একটিই—মশা নিয়ন্ত্রণ। অবশ্যই সিটি কর্পোরেশনের দায়িত্ব থাকে। কিন্তু বাসার মধ্যেই মশার প্রাদুর্ভাব বেশি, মশার উৎপাদন হয় বাসাগুলোতে। তাই জনসচেতনতা এখানে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মশার সার্ভেতে দেখা যাচ্ছে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই টায়ারের মধ্যে, মিটারের নিচে, টবের মধ্যে মশার লার্ভা পাওয়া যাচ্ছে। এখানে তো আমাকে-আপনাকে সতর্ক হতে হবে।’
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের লাইন ডিরেক্টর (সংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ) মো. হালিমুর রশিদ বলেন ‘ডেঙ্গুর যে প্রিভেনশন (প্রতিরোধ), সেটিই চিকুনগুনিয়ার প্রিভেনশন—মশা মারা। গত মঙ্গলবার মশা নিয়ন্ত্রণ নিয়ে আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠক হয়েছে। সব স্টেকহোল্ডাররা উপস্থিত ছিলেন। কিভাবে মশা মারা যায়, মশার উপদ্রব কমানো যায়—তা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। সিটি কর্পোরেশন যথেষ্ট কাজ করছে। তবে খুব ফায়দা তো হবে না, কারণ বাড়ির ভিতরে সিটি কর্পোরেশন যেতে পারে না। মানুষ সচেতন না হলে এটা সম্ভব না।’
মশা নিয়ন্ত্রণে উদ্যোগের বিষয়ে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের কারো মন্তব্য পাওয়া যায়নি। জানতে চাইলে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের (ডিএসসিসি) প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. নিশাত পারভীন মেডিভয়েসকে মশার ওষুধ প্রয়োগের পাশাপাশি পরিচ্ছন্নতা ও জনসচেতনতার উপর জোর দেওয়ার কথা জানান।
তিনি বলেন, ‘প্রতি সপ্তাহে নির্দিষ্ট এলাকায় চিরুনি অভিযান চালাচ্ছি। পাশাপাশি প্রতি শুক্রবার জুমার খুতবায় সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য বলছি, একই সাথে স্কুলগুলোতে সচেতনতা অনুষ্ঠান করছি। বিভিন্ন জোনের বিভিন্ন কমিউনিটির প্রতিনিধিদের নিয়েও বৈঠক করছি। নিয়মিত ওষুধের পাশাপাশি মনিটরিং করছি। ডেঙ্গু আক্রান্ত হলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তালিকা ধরে এলাকায় গিয়ে ওষুধ দিচ্ছি। কিন্তু ডেঙ্গু কিংবা চিকুনগুনিয়া নিয়ন্ত্রণের জন্য আমাদের নিজেদের সচেতন হতে হবে। ঘরের ভিতর যদি এডিস লালন-পালন করি, তাহলে তো এত আয়োজন কাজে আসবে না।’
সচেতনতা বৃদ্ধিতে ডিএসসিসি এলাকায় জুন থেকে ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান পরিচালনা করা হবে বলেও জানিয়েছেন ডা. নিশাত পারভীন।
এমইউ