রক্তদান শব্দটির সাথে সকলেই কমবেশি পরিচিত। একজন মানুষের রক্তের বিনিময়ে অপর একজন মানুষের জীবন ফিরে পাওয়া। একে বিজ্ঞানের শুধু বিস্ময়কর আবিষ্কার বললে ভুল হবে, এ যেন এক জাদুর ছোঁয়া। বহুদিন আগে থেকেই রক্তদানের এই ধারা অব্যাহত আছে এবং প্রতি বছর ১৪ জুন বিশ্ব রক্তদাতা দিবস হিসেবে পালন করা হয়। বিশ্বব্যাপী রক্তদান সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে প্রতিবছর নানা কর্মসূচির আয়োজন করা হয়। তবুও জনমনে এ নিয়ে রয়েছে হাজারো প্রশ্ন-সংশয়।
কেন রক্তদান করবেন?
রক্ত হচ্ছে আমাদের শরীরে বিশেষ ধরনের একটি তরল টিস্যু, যার কোন সাবস্টিটিউট বা বিকল্প নেই এবং সারা বিশ্বে গড়ে প্রতি তিন সেকেন্ডে একজন মানুষের রক্তের প্রয়োজন হয়। অর্থাৎ একজন মানুষের রক্তের প্রয়োজন হলে তাকে অবশ্যই অন্য একজন মানুষের উপর নির্ভর করতে হবে এবং তার বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন অপর একজন মানুষের রক্ত। সুতরাং একজন মানুষকে সুস্থ করে তোলা কিংবা তার বেঁচে থাকার জন্য রক্তদান প্রয়োজন।
রক্তদানের দাতার ক্ষতি হয়?
প্রশ্নটি অনেক স্বাভাবিক। আমাদের শরীরে যে রক্ত কণিকা রয়েছে সেগুলো চার মাস অর্থাৎ ১২০ দিন পর আপনিই নষ্ট হয়ে যায়। এগুলো কাউকে দান করা হোক বা না হোক চার মাস পর নতুন রক্তকণিকা জন্ম নেয়। যেহেতু চার মাস পর পর নতুন রক্ত কণিকা জন্ম নিচ্ছে এবং আমাদের আগের রক্ত কণিকাগুলো কোন কাজে আসছে না সেহেতু প্রতি চার মাস অন্তর রক্তদানে শরীরের কোনো ক্ষতি হয় না।
নেওয়া যায় যে কারো রক্ত
না। রক্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে অবশ্যই রক্তদাতা এবং রক্তগ্রহীতার রক্তের গ্রুপ মিল থাকতে হবে এবং পাশাপাশি অন্যান্য পরীক্ষার ফলাফলও সঙ্গতিপূর্ণ হতে হবে। অন্যথায় ইহা রক্তগ্রহীতার জীবন নাশেরও কারণ হতে পারে।
রক্তদাতার শারীরিক যোগ্যতা
রক্তদাতাকে অবশ্যই সুস্থ ও স্বাভাবিক হতে হবে। রক্তদাতার বয়স ১৮ থেকে ৬০ বছরের মধ্যে হতে হবে। রক্তদাতার ব্লাড প্রেসার স্বাভাকি থাকতে হবে অর্থাৎ সিস্টোলিক ব্লাড প্রেসার ১০০ থেকে ১৩০ মিলিমিটার অব মার্কারি এবং ডায়াস্টোলিক প্রেসার ৭০ থেকে ৯০ মিলিমিটার অব মার্কারি। সেই সাথে ৬০ থেকে ৯০ বিটস পার মিনিট রেগুলার পালস এবং শরীরের তাপমাত্রা স্বাভাবিক থাকতে হবে। রক্তে হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ ১২.৫ গ্রাম পার ডিএলের বেশি থাকতে হবে। পূর্বের রক্তদান করে থাকলে অবশ্যই চার মাস পূর্ণ হতে হবে। সেই সঙ্গে মনে রাখতে হবে, কোন প্রকার অসুস্থতা নিয়ে রক্তদান করা যাবে না। বিশেষ করে এইচআইভি, হেপাটাইটিস বি, হেপাটাইটিস সি, সিফিলিস এবং ম্যালেরিয়া রিপোর্ট নেগেটিভ হতে হবে। রক্তদানের পূর্বে অবশ্যই খাওয়া-দাওয়া করে নিতে হবে। খালি পেটে কোন অবস্থায় রক্তদান করা যাবে না।
যখন রক্তদানে মানা
কোন এসপিরিন বা এসপিরিন জাতীয় ওষুধ গ্রহণ করলে ৭২ ঘণ্টা তথা তিন দিন রক্তদান থেকে বিরত থাকতে হবে এবং কোন ননস্টেরয়েড এন্টি ইনফ্লামেটরি ড্রাগ সেবন করলে ৪৮ ঘণ্টা পর রক্তদান করা যাবে। তবে কেউ যদি কোন অ্যান্টিবায়োটিক সেবন করতে থাকেন তাহলে অ্যান্টিবায়োটিকের ডোজ কমপ্লিট হওয়ার দুই সপ্তাহ পর রক্তদান করা যাবে। পাশাপাশি সামান্য জ্বর, সর্দি, গলা ব্যথা, কিংবা দাঁত তোলার পরে রক্তদানের জন্য এক সপ্তাহ অপেক্ষা করতে হবে। তবে কোন কোন কারণে এক মাস থেকে এক বছর পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হতে পারে। একমাস অপেক্ষা করার কারণসমূহের মধ্যে রয়েছে রক্তে হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ কম হওয়া, পালস রেট অনেক বেশি বা অনেক কমে যাওয়া, অস্বাভাবিক রক্তচাপ কিংবা কোন লাইভ ভ্যাকসিন নিয়ে থাকলে। সেইসাথে এক বছর অপেক্ষা করার কারণসমূহের মধ্যে পূর্বে কখনো রক্ত নিয়ে থাকলে বা কোন অর্গান ট্রান্সপ্লান্টেশন করে থাকলে কিংবা কোন রেবিট এনিমেলের কামড়ের পর ভ্যাকসিন গ্রহণ করে থাকলে। শরীরে কোন ট্যাটু, নাক অথবা কান ফুটো, হেপাটাইটিস রোগীর সংস্পর্শে যাওয়া, ম্যালেরিয়া জন্য কোন ওষুষধ খাওয়া কিংবা ম্যালেরিয়ার প্রকোপ রয়েছে, এমন কোন স্থানে ভ্রমণ করা অথবা বড় রকমের কোন সার্জারি করলেও রক্তদানের জন্য এক বছর অপেক্ষা করতে হবে।
আবার বিশেষ কিছু কারণ রয়েছে, যেগুলোর জন্য কখনোই রক্তদান করা যাবে না। যেমন–ব্লিডিং ডিসঅর্ডার, ক্যান্সার, ইনসুলিন গ্রহণকারী ডায়াবেটিক রোগী, মৃগী রোগী, কিডনি কিংবা হার্টের রোগী, মাদক সেবনকারী, কালাজ্বর, যক্ষা, হেপাটাইটিস বি, হেপাটাইটিস সি এবং এইচআইভি পজিটিভ রোগী।
প্রফেশনাল ডোনারের রক্তগ্রহণ নয়
ভলেন্টারি বা স্বেচ্ছায় রক্তদানকারী, রিপ্লেসমেন্ট ডোনার বা রোগীর নিজ পরিবার কিংবা সমাজ থেকে রক্তদানকারী, অটো লোগাস ডোনার কিংবা নিজের রক্ত নিজেকে দান করা, এফেরেসিস ডোনার বা রক্তের যেকোনো একটি উপাদান দানকারী এবং প্রফেশনাল ডোনার বা টাকার বিনিময়ে যারা রক্তদান করেন। সবশেষে উল্লেখিত ডোনার অর্থাৎ প্রফেশনাল ডোনার সব থেকে খারাপ ডোনার হিসেবে পরিচিত। এদের থেকে যথাসম্ভব রক্ত গ্রহণ না করার চেষ্টা করতে হবে।
নারী-পুরুষ সকলেই রক্তদানে সক্ষম
হ্যাঁ। নারী-পুরুষ সকলে রক্তদান করতে পারবেন এবং রক্তদানের জন্য যে শর্তাবলী পূর্বে আলোচনা করা হয়েছে তার সবগুলো পূরণ করা সাপেক্ষেই কেবল একজন নারী কিংবা পুরুষ রক্তদানের জন্য উপযুক্ত বলে বিবেচনা করা হবে। তবে একজন নারীর ক্ষেত্রে কয়েকটি বিষয়ের প্রতি খেয়াল রাখতে হবে। যেমন–মাসিক চলাকালীন অবস্থায় রক্তদান করা যাবে না, প্রেগনেন্সি কিংবা বাচ্চাকে বুকের দুধ পান করানো অবস্থায়ও রক্তদান করা যাবে না। সাধারণত মহিলাদের ক্ষেত্রে প্রেগনেন্সি কিংবা ডেলিভারির ছয় সপ্তাহ পর পর্যন্ত রক্তদান থেকে বিরত থাকতে বলা হয়।
রক্তদানের পর করণীয়
রক্তদানের পরবর্তী ২৪ ঘণ্টা অবশ্যই প্রচুর পরিমাণে পানি পান করতে হবে, ধুমপান করা যাবে না এবং অতিরিক্তকারিক পরিশ্রম থেকে বিরত থাকতে হবে। সেই সাথে রক্তদানের পরবর্তী কমপক্ষে আধা ঘণ্টা গাড়ি চালানো থেকে বিরত থাকতে হবে।
রোগীর শরীরে রক্ত পরিসঞ্চালনের পূর্বে কয়েকটি বিষয় খুব ভালোভাবে খেয়াল করতে হবে। যথা–ক্রস ম্যাচিং ও স্ক্রিনিং রিপোর্ট ছাড়া রক্ত পরিসঞ্চালন করা যাবে না। রোগী পূর্বে রক্ত গ্রহণ করার পর বিরূপ প্রতিক্রিয়া হয়েছিল কিনা তা জেনে নিতে হবে। রক্ত ফ্রিজ থেকে বের করার ৩০ মিনিটের বেশি সময় বাহিরে রাখা যাবে না এবং ফ্রিজ থেকে বের করে সঙ্গে সঙ্গে রোগীকে ঠাণ্ডা রক্ত পরিসঞ্চালন করা যাবে না। রক্ত পরিসঞ্চালন করার সময় প্রতিক্রিয়া হলে রক্ত দেওয়া বন্ধ করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে এবং সাথে সাথে যথাযথ কর্তৃপক্ষ কিংবা ট্রান্সফিউশন মেডিসিন বিভাগকে অবহিত করে পরবর্তী পদক্ষেপ নিতে হবে।
রোগীকে কখন রক্ত দিতে হবে
কোন দুর্ঘটনা, আঘাত, বড় রকমের কোন অপারেশন অথবা শরীরে রক্তের অস্বাভাবিকতাজনিত কোন রোগের জন্য শরীর থেকে রক্তপাত হলে রোগীকে বাইরে থেকে রক্ত পরিসঞ্চালন করতে হবে। শরীরের যদি রক্ত জমাট বাঁধার উপকরণের ঘাটতি থাকে কিংবা রক্তস্বল্পতা থাকে অথবা শরীরের কোন অংশ অনেক বেশি পুড়ে গিয়ে শরীর থেকে অনেক রক্ত বের হয়ে যায়, তখন সেই ঘাটতি পূরণে রোগীকে অবশ্যই বাইরে থেকে রক্ত পরিসঞ্চালন করতে হবে।
কখন রক্ত পরিসঞ্চালনে মানা
শরীরের তাপমাত্রা অনেক বেশি থাকলে, রক্তের চাপ অস্বাভাবিক থাকলে, হার্টের কোনো অসুখ যেমন–হার্ট ফেইলিওর হলে, পালমোনারি ইডিমা কিংবা খাদ্যের কোন উপাদানের ঘাটতিজনিত কারণে রক্তস্বল্পতা থাকলে রোগীকে রক্ত পরিসঞ্চালন করা যাবে না।
রক্ত গ্রহণের পর বিরূপ প্রতিক্রিয়া
রক্ত গ্রহণের পর রোগীর শরীরে নানা রকম প্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে রক্ত গ্রহণ করার সাথে সাথে কিংবা পরবর্তী ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই দেখা দেয়, যেমন– হিমোলাইসিস বা রক্ত ভেঙে যাওয়া, এলার্জিক রিঅ্যাকশন, শ্বাস কষ্ট, ব্যাকটেরিয়া বা অনুজীবের আক্রমণ, শরীরের রক্তের চাপ বেড়ে যাওয়া কিংবা শরীরের তাপমাত্রা অস্বাভাবিক বেড়ে বা কমে যাওয়া। এগুলো ছাড়াও কিছু সমস্যা রক্ত গ্রহণের দু-একদিন পর থেকে শুরু করে বেশ কিছুদিন পর পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে। যেমন– শরীরে ফুসকুড়ি বা র্যাশ উঠা, হিমালাইসিস বা রক্তের কণিকা ভেঙে যাওয়া, শরীরের বিভিন্ন অর্গানের বিপরীতে নানা রকম রিঅ্যাকশন দেখা দেওয়া (গ্রাফট ভার্সেস হোস্ট ডিজিস) এবং সংক্রামক রোগ। এসবের যেকোনো একটি উপসর্গ দেখা দিলে দ্রুত ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে হবে এবং প্রয়োজনীয় চিকিৎসা গ্রহণ করতে হবে।
নিরাপদ রক্ত গ্রহণ এবং রক্তদানের মাধ্যমে যেমন একটি জীবন বাঁচানো সম্ভব, তেমনি অনিরাপদ রক্তদান এবং রক্ত গ্রহণের মাধ্যমে জীবননাশের মত অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাও ঘটে যেতে পারে। তাই রক্তদান এবং রক্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে অবশ্যই সর্তকতা অবলম্বন করতে হবে। রক্তদাতাকে অবশ্যই স্মরণ রাখতে হবে তার মাধ্যমে একজন মানুষের জীবন বাঁচানোর যেই সুবর্ণ সুযোগ সৃষ্টিকর্তা তাকে করে দিয়েছেন সবাই হয়তো এমন সুযোগ পায় না। সেই সাথে রক্ত গ্রহীতা এবং তার পরিবারকেও রক্তদাতার প্রতি যথেষ্ট সহানুভূতি, সহমর্মিতা ও কৃতজ্ঞতা পোষণ করতে হবে।
লেখক
মো. ইশতিয়াক আহাম্মেদ
ইব্রাহীম মেডিকেল কলেজ, বারডেম,ঢাকা।
এমবিবিএস(শেষ বর্ষ)